কয়েকটি কক্ষ এবং কয়েকটি করিডোর পার করে আমাকে মাঝারি একটি হলঘরে উপস্থিত করা হল, সেখানে একটি বড় টেবিলকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ বসে ছিল। আমাকে দেখে একজন সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, সে কী! তোমার এ কী চেহারা হয়েছে?
আমি ভাঙা গলায় বললাম, তুমি কি সত্যিই অবাক হয়েছ?
না। খুব অবাক হই নি। তোমার অবস্থায় হলে সম্ভবত আমিও এভাবে ভেঙে পড়তাম।
আমি লোকটার কথায় কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম না। তার সামনে চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, আমাকে তোমরা কেন গ্রেপ্তার করে এনেছ? কেন এখনো ধরে রেখেছ?
সে কথাটাই তোমাকে বলার জন্যে ডেকে এনেছি।
আমি একটু আশা নিয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। কিন্তু তার মাছের মতো নিস্পৃহ চোখের দৃষ্টি দেখে হঠাৎ এক ধরনের আতংকে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। মানুষটি তার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান, একটি রাষ্ট্রের বিশাল শক্তি ব্যয় হয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীদের ধরা এবং তাদের বিচার করার জন্যে।
মানুষটি ঠিক কী বলতে চাইছে আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমি তবু যন্ত্রের মতো মাথা নাড়লাম। মানুষটি বলল, রাষ্ট্র এই খাতে অর্থব্যয় কমানোর জন্যে নূতন একটি সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে।
সিস্টেম?
হ্যাঁ। তার নাম দেয়া হয়েছে সিস্টেম এডিফাস।
এডিফাস?
হ্যাঁ। এই সিস্টেমের নিয়ম হল যখন কোনো অপরাধ ঘটবে তখন অপরাধের আশপাশে সবাইকে ধরে নিয়ে আসা হবে।
সবাইকে?
হ্যাঁ, কারণ এটাই সবচেয়ে সহজ। এটা করতে হলে কোনো অনুসন্ধান করতে হয়, কোনো তদন্ত করতে হয় না, ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তাভাবনা–গবেষণা করতে হয় না। সবাইকে যখন ধরে আনা হয় তখন সিস্টেম এডিফাস তাদের সবাইকে জেরা করে। জেরা। করে বের করে কে সত্যি বলছে কে মিথ্যা বলছে। সেখান থেকে অপরাধী খুঁজে বের করা হয়। শুধু তাই নয়, অপরাধের গুরুত্ব বের করা হয়।
মানুষটি নিশ্বাস নেবার জন্যে একটু অপেক্ষা করল, আমি কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
যখন অপরাধের গুরুত্ব বের করা হয় তখন তাকে শাস্তি দেয়া হয়। সিস্টেম এডিফাসের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তখন সে শাস্তি কার্যকর করতে পারে। কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক শোধন, স্মৃতি পরিবর্তন, কারাদণ্ড যাকে যেটা দেয়া প্রয়োজন সেটা দিয়ে দিতে পারে। বিশাল তথ্যকেন্দ্র থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বলতে পার সিস্টেম এডিফাস দিয়ে একটি দেশের নিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র দপ্তর এবং বিচার বিভাগকে অবলুপ্ত করে দেয়া হবে।
আমি হতবাক হয়ে কোনোভাবে বললাম, এই সিস্টেমটা ঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে? এটি নির্ভুলভাবে কাজ করে?
অবশ্যি কাজ করে। মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, গত দশ বছর থেকে হাজারখানেক বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার এটার পিছনে কাজ করছে। বিশাল রিসার্চ করে এটা দাঁড় করানো হয়েছে। মৃত্যুকূপের সাথে যে ইন্টারফেস
মৃত্যুকূপ?
হ্যাঁ। মানুষটি সোজা হয়ে বলল, যদি দেখা যায় কারো অপরাধের জন্যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া দরকার সিস্টেম এডিফাস তখন মানুষটাকে মৃত্যুকূপে নিয়ে হত্যা করে।
আমি আতংকিত হয়ে বললাম, কীভাবে করে?
অনেক রকম উপায় রয়েছে। ইলেকট্রিক শক, হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস, বিষাক্ত ইনজেকশান, গুলিবর্ষণ, রক্তক্ষরণ, উচ্চচাপ কিংবা উচ্চতাপ–যার জন্যে যেটা প্রয়োজন। শুধু এই ইন্টারফেসটা তৈরি করতেই ছয় বছর সময় লেগেছে।
আমি রক্তশূন্য মুখে মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে এই সিস্টেম এডিফাস কাজ করছে?
মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, মাত্র কিছুদিন হল শুরু করা হয়েছে। বলতে পার এটা এখনো পরীক্ষামূলক। প্রথম কয়েক বছর তথ্য সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে দেখা
আমি বাধা দিয়ে বললাম, যেখানে মানুষের জীবন–মরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেটা একটা পরীক্ষামূলক সিস্টেম? আমাকে দিয়েও পরীক্ষা করা হবে?
হ্যাঁ। তোমার ব্যাপারটি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তুমি দাবি করছ যে তুমি নিরপরাধ, অথচ আমাদের প্রাথমিক তথ্য বলছে তুমি অপরাধী। আমরা দেখতে চাই সিস্টেম এডিফাস কীভাবে এটার মীমাংসা করে।
আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, আমি একটা পরীক্ষার বিষয়বস্তু? আমি একটা গিনিপিগ? এক টুকরা তথ্য?
জিনিসটা এভাবে দেখার প্রয়োজন নেই। তবে
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি কোনো পরীক্ষার গিনিপিগ হতে চাই না।
মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, তুমি না চাইলেই তো হবে না। এটা একটি দেশের সিদ্ধান্ত। একটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত। একটা আইন
আমি এই আইন মানি না।
মানুষটি তার মাথা বাঁকা করে বলল, শুধুমাত্র এই কথাটি বলার জন্যেই দেশদ্রোহিতা আইনে তোমার সাজা হতে পারে।
আমি চিৎকার করে বললাম, হলে হোক। কিন্তু সেটা হতে হবে নিয়মের ভিতরে। আমি উজবুক কোনো সিস্টেমকে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না।
মানুষটি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সুইচ টিপে বলল, সাত নম্বর সেলে নিয়ে যাও।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, আমি যাব না। কিছুতেই যাব না।
আমার কথা শেষ হবার আগেই দরজা খুলে বিশাল আকারের দুজন মানুষ এসে আমাকে দুপাশ থেকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিতে শুরু করল।