আজকেও আমি তাই করছিলাম, বেঞ্চে বসে প্রোটিন এবং স্টার্চের ক্যাপসুলটা চুষতে চুষতে মানুষগুলির মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের ভাব অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম। বয়স্ক একজন মানুষকে দেখে মনে হল কোনো কিছু নিয়ে তার ভিতরে খুব যন্ত্রণা–কে জানে হয়তো তার সর্বশেষ স্ত্রী ধনবান কোনো এক তরুণের সাথে পালিয়ে গেছে। হাস্যোজ্জ্বল একজন তরুণীকে দেখে মনে হল হয়তো তার ভালবাসার মানুষটি আজকে তাকে ভালবাসা। নিবেদন করেছে। কমবয়সী নিরাসক্ত ধরনের একজন তরুণকে দেখে মনে হল সে হয়তো নতুন কোনো একটি মাদকের সন্ধান পেয়েছে। পিছু থেকে ধীরপায়ে হেঁটে আসা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দেখে মনে হল তার ভিতরে এক ধরনের শান্ত সমাহিত ভাব চলে এসেছে— পৃথিবীর তুচ্ছ কোনো ব্যাপারে তার আর কোনো আকর্ষণ নেই। তার নির্লিপ্ত চেহারার মাঝে এক ধরনের ঐশ্বরিক পবিত্রতার ছাপ। মানুষটির কাছেই একজন প্রৌঢ়া রমণী, তার পোশাক এবং চেহারায় বিচিত্র এক ধরনের কৃত্রিমতা দেখে মনে হয় কোনো এক ধরনের কুটিল চিন্তায় মগ্ন।
ঠিক এই সময় আমি রনোগানের তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পেলাম। ঢিপঢিপ করে নিচু কয়েকটা শব্দ হল এবং আমি মানুষের আর্তনাদ শুনে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম, একটু আগে দেখা মধ্যবয়সী শান্ত সমাহিত মানুষটি তার মুখের সমস্ত পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রেখে দুই হাতে দুটি ভয়ংকরদর্শন রনোগান নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে যাচ্ছে। আমার সামনেই আরেকজন চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল।
আমি হতবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক তখন আরো কয়েকজনকে ছোটাছুটি করতে দেলাম, আরো কিছু গোলাগুলি হল এবং হঠাৎ করে শান্ত সমাহিত চেহারার মানুষটি তার মুখের পবিত্র ভাব নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমার দিকে ছুটে এল, তার আগেই কেউ একজন তাকে গুলি করল এবং আমি কিছু বোঝার আগেই মানুষটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আমার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
. আমি নিয়মিত ছায়াছবি দেখি এবং রগরগে ত্রিমাত্রিক রহস্য ছায়াছবিতে বহুবার গুলিবিদ্ধ চরিত্র আমাদের মতো দর্শকদের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, কিন্তু প্রকৃত এই ঘটনাটি ছায়াছবি থেকে একেবারেই ভিন্ন। গুলিবিদ্ধ মানুষটি ভয়ংকরভাবে ছটফট করতে লাগল এবং শরীরের বিভিন্ন ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। তার হাত থেকে রনোগানটি নিচে গড়িয়ে পড়ল এবং আমি কিছু না বুঝে সেটি হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে নির্বোধের মতো চিৎকার করতে থাকলাম।
ঘটনার আকস্মিকতাটুকু কেটে যাবার পর আমি আবিষ্কার করলাম নিরাপত্তাবাহিনীর লোকেরা আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানতে চাওয়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত কাটখোট্টা মহিলাটি তার মুখে যেটুকু কমনীয়তা আনা সম্ভব সেটুকু এনে মিষ্টি করে বলল যে ব্যাপারটি তাদের সদরদপ্তরে নিষ্পত্তি করা হবে। ব্যাপারটি যে আসলেই একটি ভুল বোঝাবুঝি এবং সদরদপ্তরের কর্মকর্তাদের সেটা বুঝিয়ে দেয়ার পরই যে আমাকে তারা ছেড়ে দেবে সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।
কাউকে কোনো অপরাধের জন্যে গ্রেপ্তার করার পর নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করে সেটা সম্পর্কে আমার খানিকটা কৌতূহল ছিল। সদরদপ্তরে এসে আবিষ্কার করলাম যে তাদের কোনো ধরনের ব্যবহারই করা হয় না। আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আসবাবপত্রহীন একটি নিরানন্দ ঘরে আটকে রাখা হল। অনেক কষ্টে আমি একজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, আমি এই ঘটনার সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই, আমাকে তোমরা কেন গ্রেপ্তার করে এনেছ?
মানুষটি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেবে আমি আশা করি নি; কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে সে তার তথ্যকেন্দ্রে উঁকি দিয়ে বলল, তোমার হাতে মানুষের বেআইনি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী মারা গেছে, তার অস্ত্র পাওয়া গেছে তোমার হাতে, কাজেই তুমি কোনোভাবে ব্যাপারটার সাথে জড়িত নও সেটা বিশ্বাস করা কঠিন।
আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিরাপত্তাবাহিনীর লোকটির দিকে তাকালাম, শান্ত সমাহিত এবং পবিত্র চেহারার মানুষটি আসলে একজন বেআইনি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী, দুর্ধর্ষ খুনে আসামি সেটি এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কাতর গলায় বললাম, তুমি বিশ্বাস কর, আমি কিছুই জানি না।
মানুষটি উদাস গলায় বলল, হতে পারে। কিন্তু তুমি ঘটনার সময়ে হাজির ছিলে। অপরাধীর দেহে তোমার শরীরের ছাপ আছে। তুমি একটা ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিলে, আমাদের কিছু করার নেই।
আমি একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই প্রথমবার ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকা কথাটির প্রকৃত অর্থ অনুভব করতে শুরু করলাম।
***
আসবাবপত্রহীন নিরানন্দ ঘরটিতে আমি দুই দিন কাটিয়ে দিলাম। সেখানে গায়ে দেয়ার জন্যে হালকা গোলাপি এক ধরনের পোশাক রাখা ছিল। খাবার বা স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। শুধু তাই নয়, বিনোদনের জন্যে যাবতীয় উপকরণ সাজিয়ে রাখা ছিল, কিন্তু আমি তার কিছুই ব্যবহার করতে পারলাম না। পুরো সময়টুকু এক ধরনের অস্বস্তিকর চাপা আতংক নিয়ে অপেক্ষা করে করে কাটিয়ে দিলাম। তৃতীয় দিনে কয়েকজন মানুষ এসে আমাকে এই নিরানন্দ ঘরটি থেকে বের করে নিয়ে গেল। আমি ততক্ষণে পুরোপুরি ভেঙে পড়া একজন দুর্বল মানুষে পরিণত হয়ে গেছি।