জামশেদের ভিতরে প্রচণ্ড একটা অপরাধবোধ এসে ভর করে। সেই ছেলেটির সাথে দেখা হলে সে ছেলেটির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে তার অপরাধের বোঝা লাঘব করে দিতে পারত। কিন্তু আর কখনো তার সাথে দেখা হয় নি। মনে মনে সে ছেলেটিকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু পৃথিবী বিশাল একটি ক্ষেত্র, সেখানে মানুষ অবলীলায় হারিয়ে যায়। এখানে মানুষ কৌশলী কোনো এক প্রোগ্রামারের অসংখ্য রাশিমালার ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর একটি রাশি, মেমোরির তুচ্ছ একটি বিট।
জামশেদ একটা নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে কখন লেকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করে নি। বিকেলবেলা জায়গাটি মানুষের ভিড়ে জনাকীর্ণ হয়ে থাকে, এখন মোটামুটি ফাঁকা। কাগজের ঠোঙা, বাদামের খোসা, সিগারেটের খালি প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, দৃশ্যটিতে কেমন যেন এক ধরনের নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা লুকিয়ে আছে। জামশেদ কী মনে করে লেকের পাশে একটা বেঞ্চে বসল। সম্পূর্ণ অকারণে তার মনটি কেন জানি খারাপ হয়ে আছে।
ভাই। হঠাৎ করে গলার স্বর শুনে জামশ্রেৰু চমকে ঘুরে তাকাল। বেঞ্চের অন্যপাশে কে যেন বসে আছে, আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। জামশেদ ভয় পাওয়া গলায় বলল, কে?
আমি ভাই। আমারে চিনতে পারছেন না?
জামশেদ ভূত দেখার মতো চর্মকে উঠল, তার ভাইয়ের বাসার সেই কাজের ছেলেটি। নাক এবং মুখ থেঁতলে আছে। অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সারা মুখ রক্তে মাখামাখি। একটি চোখ বুজে আছে।
তুই?
হ্যাঁ।
তু–তুই কোথা থেকে? তোর চেহারা এরকম কেন?
মনে নাই? আপনি বেগম সাহেবের সোনার বালা চুরি করলেন? তারপরে
তুই কেমন করে জানিস?
আমি জানি। তারপর সবাই আমাকে মিলে মারলেন। এই দেখেন সামনের দুইটা দাঁত ভেঙে গেছে— ছেলেটি আবছা অন্ধকারে তার মুখ খুলে দেখানোর চেষ্টা করল, জামশেদ ভালো করে দেখতে পারল না।
জামশেদের সারা শরীরে হঠাৎ কাঁটা দিয়ে ওঠে–এটি কি সত্যি? সে ভালো করে তাকাল, আবছা অন্ধকারে সত্যি সত্যি ছেলেটি বেঞ্চের অন্যপাশে বসে আছে। এত কাছে যে সে হাত বাড়ালে স্পর্শ করতে পারবে। জামশেদ খানিকক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থেকে বলল, তুই কোথা থেকে এসেছিস?
ছেলেটি অনির্দিষ্টভাবে বলল, হুই ওখান থেকে।
কেন?
আপনি আমার সাথে দেখা করতে চান সেই জন্যে।
তুই কেমন করে জানিস?
ছেলেটি উদাস গলায় বলল, আমি জানি।
.
জামশেদ হঠাৎ হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারে। তার অনুমান সত্যি। এই সমস্ত জগৎ আকাশ–বাতাস, মানুষ, পশুপাখি, সভ্যতা, জ্ঞান–বিজ্ঞান আসলে একজন কৌশলী প্রোগ্রামারের সৃষ্টি। কোনো প্রোগ্রাম নিখুঁত নয়, তার ত্রুটি থাকে। ভারচুয়াল রিয়েলিটির প্রোগ্রামে ত্রুটি ছিল, সেই ক্রটিতে স্পর্শ করামাত্র এক্স পি জি কে ৩৯০ সুপার কম্পিউটারের সমস্ত সিস্টেম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ছোট একটা ত্রুটি সযত্নে গড়ে তোলা জটিল একটা প্রোগ্রামকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিশাল এই সৃষ্টিজগতের এই প্রোগ্রামেরও ত্রুটি আছে, সেই ত্রুটিটি তার চোখের সামনে ধরা পড়েছে। তার বাসার কাজের ছেলেটি তার কাছে এসে বসে আছে। কোনো যুক্তি নেই, কোনো কারণ নেই, তবু সে চুপচাপ বসে আছে। এখন এই ত্রুটিটি স্পর্শ করলে কি এই প্রোগ্রামটিও ধ্বংস হয়ে যাবে?
জামশেদ আবার ঘুরে তাকাল, মনেপ্রাণে সে আশা করছিল সে তাকিয়ে দেখবে তার পাশে কেউ নেই, পুরোটা তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের একটা কল্পনা। কিন্তু সেটা সত্যি নয়, তার পাশে ছেলেটি বসে আছে। মুখ রক্তাক্ত, ঠোঁটটা কেটে গেছে, একটা চোখ বুজে আছে।
জামশেদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, দেখতে পেল তার পাশে খুব ধীরে ধীরে দ্বিতীয় আরেকজন ছেলে স্পষ্ট হয়ে আসছে। হুবহু একই রকম চেহারা, স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার পাশে আরেকজন। তার পাশে আরো অসংখ্য। হ্যাঁ, এটি একটি ক্রটি। নিঃসন্দেহে প্রোগ্রামের একটি ক্রটি।
জামশেদ চোখ বন্ধ করে ফেলল, না সে আর দেখতে চায় না। বিশাল এই প্রোগ্রামের ত্রুটিটি স্পর্শ করে পুরো সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস করে দিতে চায় না। সে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে, যেন একটু নড়লেই পুরো সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল সে জানে না। এক সময় সে চোখ খুলে তাকাল। চারদিকে অসংখ্য ছেলে, মুখ রক্তাক্ত, থেঁতলানো ঠোঁট, চোখ বুজে আছে যন্ত্রণায়। সবাই স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা কি সত্যিই আছে নাকি একটা বিভ্রম? একবার কি ছুঁয়ে দেখবে?
স্পর্শ করবে না করবে না ভেবেও জামশেদ তার হাত এগিয়ে দিল ছোঁয়ার জন্যে…
***
কী হল?
পুরোটা আবার ধ্বংস হয়ে গেল।
আবার চালু করবে?
দীর্ঘ সময় নীরবতার পর কে যেন বলল, নাহ্! আর ইচ্ছে করছে না।
সিস্টেম এডিফাস
এটাকেই নিশ্চয়ই বলে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকা।
দুপুরবেলা আমাদের খানিকক্ষণের জন্যে কাজের বিরতি দেয়া হয়। আমি তখন আমার আকাশের কাছাকাছি অফিস থেকে নিচে নেমে আসি। ঠিক কী কারণ জানি না, মাটির কাছাকাছি এলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। পথের ধারের রবোষ্ট্যান্ড থেকে প্রোটিন এবং স্টার্চের একটা জুতসই মিশ্রণের ক্যাপসুল কিনে এনে আমি সাজিয়ে রাখা ভ্রাম্যমাণ বেঞ্চগুলিতে বসে পড়ি। বেঞ্চগুলি তার প্রোগ্রাম করা পথে ঘুরে বেড়ায়, আমি চুপচাপ বসে। থেকে পথেঘাটে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করা মানুষগুলিকে দেখি। আমার নিজেকে তখন অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হয়, আমি কল্পনা করি আমার সামনে যেন একটি আন্তঃমহাজাগতিক জানালা খুলে গেছে এবং আমি অন্য কোনো একটি গ্যালাক্সি থেকে পৃথিবীর বিচিত্র কিছু প্রাণীকে দেখছি। বসে বসে আমার তখন মানুষের মনের ভাব অনুমান করতে খুব ভালো লাগে।