তিন মাসের এই উচ্চাভিলাষী কোর্সের দ্বিতীয় মাসের দিকে জামশেদ আবিষ্কার করল এখানে তার শেখার মতো আর কিছুই বাকি নেই। যে স্বল্প সময় তাকে কম্পিউটারের সামনে বসতে দেয়া হয় সেটি তার জন্যে যথেষ্ট নয়, যে করেই হোক তাকে এই রহস্যময় যন্ত্রটিকে আরো দীর্ঘ সময়ের জন্যে পেতে হবে। যে পদ্ধতিতে সে এই কোর্সের ব্যয়ভার বহন করেছে। সেই একই পদ্ধতিতে কম্পিউটার কেনা সম্ভব নয়, কিন্তু একটি কম্পিউটারকে চব্বিশ ঘণ্টা কাছাকাছি না পেলে সে যে ভয়ানক কিছু একটা করে ফেলতে পারে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
জামশেদের ভয়ানক কিছু করার প্রয়োজন হল না। কারণ তার একটি অভাবিত সুযোগ এসে গেল। কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের অর্ধশিক্ষিত ইন্সট্রাক্টর ভদ্রলোক স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নিয়ে চলে গেল। ট্রেনিং সেন্টারের মালিক প্রায় এক ডজন নানা ধরনের ছাত্র নিয়ে অত্যন্ত বিপদের মাঝে পড়ে গেলেন। ছাত্রদের সবাইও তাদের টাকা ফেরত দেয়ার দাবি করতে লাগল। ট্রেনিং সেন্টারের মালিক যখন কোর্স শেষ করার জন্যে পাগলের মতো একজন ইন্সট্রাক্টর খোঁজ করছিলেন তখন জামশেদ তার কাছে কাজ চালিয়ে নেবার প্রস্তাব দিল। জামশেদের প্রস্তাব প্রথমে ট্রেনিং সেন্টারের মালিকের কাছে অত্যন্ত হাস্যকর মনে হলেও জামশেদ কিছুক্ষণের মাঝে তার কাছে নিজের কর্মক্ষমতা প্রমাণ করে দিল। কোর্সের ছাত্রদের কাছে ব্যাপারটি গ্রহণ করানো অনেক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা গেল। যে মানুষটি তাদের সাথে বসে একটা জিনিস শেখা শুরু করেছে এখন সে–ই তাদেরকে শেখাবে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তারা যখন আবিষ্কার করল আগের ইন্সট্রাক্টর নিজের ধোঁয়াটে জ্ঞানের কারণে তাদেরকে অন্ধকারে রেখে দিয়েছিল এবং জামশেদ তাদেরকে সেই অন্ধকার থেকে আলোতে টেনে আনছে–শুধু তাই নয়, কম্পিউটার জগতের নানা গলি–ঘুজির মাঝে কোনটিতে এখন প্রবেশ করা যায়, কোনটিতে উঁকি দেয়া যায় এবং আপাতত কোনটি থেকে দূরে থাকাই ভালো সে বিষয়টিও হাতে ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছে তখন জামশেদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার সীমা রইল না।
জামশেদের জীবনে তখন একটি বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটতে শুরু করল। কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে তার কাছে অফিসঘরের চাবি থাকে। সে যখন খুশি অফিসে আসতে পারে এবং কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে পারে। মাসশেষে সে বেতন পেতে শুরু করল, সেই বেতনের টাকা দিয়ে সে তার বহুদিনের শখ একটি সানগ্লাস এবং প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের ওপর বই কিনে আনল। ইংরেজি বই পড়তে গিয়ে সে পদে পদে হোঁচট খেয়ে প্রথমবার যথেষ্ট ইংরেজি না জানার জন্যে নিজেকে অভিশাপ দিতে লাগল।
জামশেদ প্যাস্কেল এবং সি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে শুরু করে কিছুদিনের মাঝেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে ঝুঁকে পড়ে এবং অন্যেরা যখন প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের রুটিনবাধা নিয়মের রাস্তা ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে চেষ্টা করতে থাকে তখন জামশেদ প্রোগ্রামিঙের অপরিচিত পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ব্যাংক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে নানা ধরনের সফটওয়ার তৈরি করে দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে সে সম্পূর্ণ নূতনভাবে দাবা খেলার একটা প্রোগ্রাম লিখল। প্রোগ্রামটি প্রচলিত সবগুলি দাবা খেলার সফটওয়ারকে হারিয়ে দেয়ায় জামশেদ অনেকটা নিশ্চিত হল–প্রোগ্রামিঙের জগতে সে। মোটামুটি ঠিক দিকেই অগ্রসর হচ্ছে।
কম্পিউটারের সাথে ঘনিষ্ঠতা হবার দুই বছরের মাঝে জামশেদের জীবনে তার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটল। একদিন ইংরেজি খবরের কাগজে সে একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখতে পেল, প্রতিষ্ঠানটি তাদের একটি প্রজেক্ট শেষ করার জন্যে কয়েকজন প্রোগ্রামার খুঁজছে। বেতন এবং সুযোগ–সুবিধের বর্ণনা অত্যন্ত লোভনীয়। কিন্তু জামশেদ আগ্রহী হল সম্পূর্ণ অন্য কারণে। প্রতিষ্ঠানটি এ দেশে প্রথম একটি সুপার কম্পিউটার স্থাপন করতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি যে ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা চাইছে জামশেদের তার কোনোটাই নেই, কিন্তু তবু সে হাল ছাড়ল না। ছোট একটা ফ্লপি ডিস্কে ভারচুয়াল রিয়েলিটির তার প্রিয় একটা প্রোগ্রাম কপি করে প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাঠিয়ে দিল।
মনে মনে আশা করলেও প্রতিষ্ঠানটি যে সত্যি সত্যি তাকে প্রোগ্রামার হিসেবে গ্রহণ করবে সেটা জামশেদ বিশ্বাস করে নি। তাই যেদিন সুদৃশ্য খামে চমৎকার একটি প্যাডে জামশেদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি এসে হাজির হল জামশেদ সেটি অনেকবার পড়েও বিশ্বাস করতে পারল না–তার থেকে ভালো ইংরেজি জানে এরকম একজনকে দিয়ে পড়িয়ে তার ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে হল।
জামশেদ তার জমানো টাকা দিয়ে একটা স্যুট তৈরি করে তার নূতন কাজে যোগ দিল। অনেক খরচ করে তৈরি করা সেই স্যুটটি জামশেদ অবশ্যি দ্বিতীয়বার পরে নি। কাজে যোগ দিয়ে আবিষ্কার করল প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার তুসভুসে একটা জিনসের প্যান্ট এবং রংওঠা বিবর্ণ একটা টি–শার্ট পরে কাজ করতে আসে। অন্য যারা রয়েছে তাদের সবারই। ইচ্ছে করে অগোছালো এবং নোংরা থাকার একটা প্রবণতা রয়েছে। একমাত্র সুবেশী মানুষটি প্রতিষ্ঠানের একজন কেরানি এবং অন্যদের সামনে তাকে কেমন জানি হাস্যকর দেখায়।