আর মানুষ?
আমরা এতদিন যেভাবে মানুষের সেবা করেছি তারা আমাদের সেভাবে সেবা করবে।
রু টেবিল থেকে মাথা তুলে বসল, তার চোখ রক্তবর্ণ, মাথার চুল এলোমেলো।
কিলি রুয়ের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, রু।
রু খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, বলল, বলুন মহামান্য কিলি।
তোমার ডানপাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সে সত্যিকারের ত্রা–তোমার মতো একজন মানুষ। তাকে নিয়ে শীতলঘরের সব মানুষকে জাগিয়ে তুলো। তাদেরকে শীতলঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে আমাদের অনেক শক্তিক্ষয় হয়।
কিন্তু _
আমি জানি আমাদের যথেষ্ট খাদ্য নেই।
তাহলে?
মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনও নেই।
প্রোগ্রামার
জামশেদ একজন প্রোগ্রামার। তার বয়স যখন ষোলো সে অত্যন্ত কষ্টেসৃষ্টে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাস করেছিল, ইংরেজি আর ফিজিক্সে আর একটু হলে ভরাডুবি হয়ে যেত। দুই বছর পরে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার আগে সে মোটামুটি পড়াশোনা করেছিল এবং হয়তো এমনিতেই পাস করে যেত। কিন্তু ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্যে ইংরেজি পরীক্ষায় দীর্ঘ রচনাটি নকল করতে গিয়ে পরীক্ষকের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল। সে যে কলেজ থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে সেখানে উঁচু গলায় ছাত্র রাজনীতি করা হয়, শ্লোগানে–ঢাকা কলেজ ভবনটিকে দূর থেকে একটা খবরের কাগজের মতো মনে হয় এবং পরীক্ষার সময় পরীক্ষকরা নকলবাজ ছাত্রদের ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। কিন্তু জামশেদের কপাল খারাপ। সে একজন আধপাগল নীতিবাগীশ শিক্ষকের হাতে ধরা পড়ে গেল। যদিও সে নিরীহ গোছের মানুষ তবুও তার সন্ত্রাসী বন্ধুদের মতো ভয় দেখানোর চেষ্টা করে দেখল– তাতে কোনো লাভ হল না, বরং উল্টো খুব দ্রুত একজন ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে হস্তান্তর করে তাকে পাকাপাকিভাবে বহিষ্কার করে দেয়া হল।
জামশেদ মাসখানেক খুব মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াল। গভীর রাতে যখন আকাশে মেঘ করে ঝড়ো বাতাস বইত তখন মাঝে মাঝে তার সমস্ত জীবন অর্থহীন মনে হত; এমনকি এক–দুবার সে আত্মহত্যা করার কথা ও চিন্তা করেছিল। আত্মহত্যা করার কোনো যন্ত্রণাহীন সহজ পরিচ্ছন্ন উপায় থাকলে সে যে তার জন্যে সত্যি সত্যি চেষ্টা করে দেখত না এ কথাটিও কেউ নিশ্চিত করে বলতে যায় না। ঠিক এরকম সময়ে জামশেদ নয়াবাজারের মোড়ে একটি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে প্রথমবারের মতো একটি কম্পিউটার দেখল।
ঘটনাটি যে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে সে সেটা তখনো জানত না। তার এক সহপাঠী যে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি হিসেবে কম্পিউটারের ওপর কোর্স নেয়ার জন্যে এই ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে– তার সাথে সময় কাটানোর জন্যে সে এই ট্রেনিং সেন্টারে এসেছিল। কম্পিউটারের মনিটরের সামনে বসে তাকে আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন কিছু কাজ করতে হচ্ছিল, কাজটি কেন করতে হচ্ছে কিছুতেই সে ব্যাপারটি ধরতে পারছিল না। অথচ দুই মিনিটের মাথায় হঠাৎ করে জামশেদের কাছে পুরো ব্যাপারটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত সহজ কাজ বলে মনে হতে থাকে। ঘণ্টা খানেকের মাঝে জামশেদ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সে তার সহপাঠীকে প্রোগ্রামিঙে। সাহায্য করতে শুরু করেছে।
মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে সেটি বোঝা খুব সহজ নয়। জামশেদের ভিতরে হঠাৎ করে কম্পিউটার নামক এই বিচিত্র যন্ত্রটির জন্যে এক ধরনের অমানবিক আগ্রহের জন্ম হল। কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের নানা ধরনের কোর্সের কোনোটিই নেয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার ছিল না এবং তার ভাইয়ের সংসারে ভাবির ফুটফরমাশ খেটে–সেটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। দিন কয়েক কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে সে একরকম বেপরোয়া হয়ে একটা সাহসের কাজ করল–একদিন তার ভাবির একটা সোনার বালা চুরি করে ফেলল।
ঘটনাটি যে জামশেদ করতে পারে সেটি ঘুণাক্ষরেও কেউ সন্দেহ করতে পারে নি। বাসার কাজের ছেলেটিকে জামশেদের বড় ভাই–যিনি তাদের অফিসের ভলিবল টিমের ক্যাপ্টেন–অমানুষিকভাবে পেটালেন, তার পরেও স্বীকার না করায় তার জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে পুলিশের হাতে দ্বিতীয়বার নৃশংসভাবে পেটানোর জন্যে তুলে দিলেন।
পুরো ব্যাপারটিতে জামশেদের ভিতরে এক ধরনের গভীর অপরাধবোধ জন্ম হল, কিন্তু তবুও একটিবারও সোনার বালাটি ফিরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নিরপরাধ এই কাজের ছেলেটিকে রক্ষা করার কথা মনে হল না। সোনার বালাটি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে কম্পিউটার নামক এই বিচিত্র জিনিসটির গহিনে প্রবেশ করার জন্যে তার ভিতরে যে দুর্দমনীয় আকর্ষণের জন্ম হয়েছে তার সাথে তুলনা করার মতো অন্য কোনো অনুভূতির সাথে সে পরিচিত নয়।
সোনার বালাটি যে মূল্যে বিক্রি করার কথা জামশেদকে তার থেকে অনেক কম মূল্যে বিক্রি করতে হল, চোরাই জিনিস দেখেই কেমন করে জানি দোকানিরা বুঝে ফেলে। টাকাগুলো হাতে পেয়েই সে নয়াবাজারের মোড়ের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের একটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল।
কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারটির সাইনবোর্ডে অনেক বড় বড় এবং ভালো ভালো কথা লেখা থাকলেও এর প্রকৃত অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। একটি আধো অন্ধকার ঘিঞ্জিঘরে কিছু প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির ভাইরাসদুষ্ট কম্পিউটার এবং একজন অশিক্ষিত ইন্সট্রাক্টর ছাড়া আর বিশেষ কিছু ছিল না। কোর্স চলাকালীন সময়ে যখন অন্য ছাত্রেরা হোঁচট খেতে খেতে এক জায়গাতেই অন্ধের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন জামশেদ অপারেটিং সিস্টেমের বেড়াজাল পার হয়ে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের সৃজনশীল ভূখণ্ডে পা দিয়ে ফেলল। অর্ধশিক্ষিত ইট্রাক্টর এই ব্যতিক্রমী ছাত্রকে পেয়ে প্রথমে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করলেও যখন আবিষ্কার করল সে তাকে আর প্রশ্ন না করে নিজে নিজেই কম্পিউটারের গহিনে প্রবেশ করে যাচ্ছে, সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।