একজন ত্রা রক্তশূন্য মুখে বলল, তুমি শুরু কোরো না রু। দোহাই তোমার।
অন্যজন বলল, হ্যাঁ, রু–তুমি বুঝতে পারছ না, এই পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হতে পারবে না। তুমি যদি রবোটটিকে খুঁজে বের কর তাহলে আমাদের একজনকে ধ্বংস করা হবে। আর যদি না কর–
রু ফিসফিস করে বলল, সমগ্র মানবজাতি ধ্বংস হবে।
.
কালো একটি টেবিলের দুপাশে বসেছে দুজন ত্রা, তাদের মাঝে এতটুকু পার্থক্য নেই, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় বুঝি একে অন্যের প্রতিবিম্ব। রু বসেছে দুজনের মাঝখানে, কিলি রুয়ের পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিলি দীর্ঘসময় দুই হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে রেখে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল, মাথা ঘুরিয়ে তাকাল দুজন ত্রায়ের দিকে, তারপর একজনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বলতে পারবে মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোথায়?
ত্রা’কে মুহূর্তের জন্যে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়, চট করে সামলে নিয়ে বলল, এককভাবে নাকি জাতিগতভাবে?
দু ভাবে কি দু রকম?
হ্যাঁ। এককভাবে তারা যোদ্ধা কিন্তু জাতিগতভাবে স্বেচ্ছাধ্বংসকারী।
রু মাথা ঘুরিয়ে তাকাল অন্যজনের দিকে, তীব্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এই কথার সাথে একমত?
না। আমি একমত নই।
কেন?
মানুষ স্বেচ্ছাধ্বংসকারী নয়। তারা যেটা করে তাতে তারা স্বেচ্ছাধ্বংসকারী হয়ে যায়, কিন্তু নিজেকে তারা ধ্বংস করতে চায় না। মানুষ সবচেয়ে ভালবাসে নিজেকে।
তাহলে তোমার মতে মানুষের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা কী?
আমার মনে হয় এটাই–যে নিজেকে ভালবাসা। নিজেকে ভালবাসার জন্যে দূরে তাকাতে পারে না।
রু একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার প্রথমজনের দিকে তাকাল, চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, ত্রা, তুমি কি বলতে পার মানুষ কি কখনো ঈশ্বরের প্রয়োজনের বাইরে যেতে পারবে?
আমার মনে হয় না।
কেন নয়?
কারণ ঈশ্বরকে গ্রহণ করা হয় বিশ্বাস থেকে, যুক্তিতর্ক থেকে নয়। তাই মানুষ সব সময় ঈশ্বরকে বিশ্বাস করবে। যখন মানুষের সব আশা শেষ হয়ে যাবে তখনো তারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করবে।
রু ঘুরে তাকাল অন্যজনের দিকে, জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মনে হয় ত্রা?
এ ব্যাপারে আমি ওর সাথে একমত। যতদিন মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বেঁচে থাকবে।
কেন?
আমার মনে হয় মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুর সাথে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের জন্ম হয় অসহায় শিশু হিসেবে, তাকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় তার মায়ের ওপর–ঠিক সে কারণেই মনে হয় মানুষের মাঝে একটা অন্যের ওপর নির্ভরতা চলে আসে। নির্ভর করার জন্যে ঈশ্বরের চাইতে ভালো আর কী হতে পারে?
রু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণের জন্যে মাথা নিচু করে নিজের চুল আঁকড়ে ধরল। প্রশ্নগুলির উত্তর সত্যি না মিথ্যে, যুক্তিপূর্ণ না অযৌক্তিক সেটি বড় কথা নয়–বড় কথা হচ্ছে প্রশ্নের উত্তরগুলি মানুষের মুখের কথা। মানুষ যেভাবে কথা বলে–খানিকটা যুক্তি খানিকটা আবেগ খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আবার খানিকটা নিশ্চয়তা–তার সবকিছুই আছে। এদের একজন মানুষ, তার কথা হবে ঠিক মানুষের মতোই, কিন্তু দ্বিতীয়জনের বেলাতেও সেই একই কথা। শুধু যে মানুষের মতো কথা তাই নয়, কথা বলার ভঙ্গি, মুখের ভাব চোখের দৃষ্টি হাত নাড়ানো মাথা ঝাঁকানো সবকিছু দুজনের একইরকম। এদের দুজনের মাঝে কে মানুষ এবং কে রবোট সেটি বের করা পুরোপুরি অসম্ভব একটি ব্যাপার। রু নিজের ভিতরে এক ধরনের অসহনীয় আতংক অনুভব করতে শুরু করে।
দীর্ঘ সময় মাথা নিচু করে থেকে আবার সে প্রশ্ন করতে শুরু করে। জীবনের সার্থকতার কথা জিজ্ঞেস করে, ভালবাসা এবং ঘৃণা নিয়ে প্রশ্ন করে, ন্যায়–অন্যায় নিয়ে প্রশ্ন করে, হিংসা এবং ক্রোধ নিয়ে প্রশ্ন করে। রু তাদেরকে উপহাস করার চেষ্টা করে, অপমান করার চেষ্টা করে, রাগানোর চেষ্টা করে, তাদেরকে ভয় দেখায়, ঘৃণার উদ্রেক করায়, তাদেরকে হাসায় এবং কাদায়, তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দেয়, তাদেরকে আশায় উজ্জীবিত করে, তাদেরকে হতাশায় নিমজ্জিত করে দেয়, কিন্তু একটিবারও সে দুজনের মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না। অবশেষে রু হাল ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, টেবিলে মাথা রেখে হঠাৎ সে ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
দুজন ত্ৰা সবিস্ময়ে রুয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর বেদনায় তাদের বুক ভেঙে যেতে চায়, উঠে তারা রুয়ের কাছে আসতে চায় কিন্তু কিলি তাদের থামিয়ে দিল, বলল, মহামান্য রু’কে কাঁদতে দিন মহামান্যা ত্রা এবং মহামান্যা ত্রা।
কেন?
মানুষের জন্যে এর থেকে বড় আর কোনো শোকের ব্যাপার হতে পারে না।
ভয় পাওয়া গলায় একজন ত্রা বলল, কেন, কেন এটি শোকের ব্যাপার?
এই মহাকাশযানের চার্টারে এই অভিযানের উদ্দেশ্য হিসেবে একটি বাক্য লেখা রয়েছে। বাক্যটি হচ্ছে এরকম: পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে দেয়া। সেই বুদ্ধিমত্তার অর্থ আর মানুষ নয়।
তাহলে কী?
বুদ্ধিমত্তার অর্থ এখন থেকে রবোট–আমরা মানুষের সমপর্যায়ের। আমরা মানুষ থেকে অনেক বেশি কর্মদক্ষ, অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী। আমরা অভিযানকে সফল করার জন্যে আমাদেরকে ছড়িয়ে দেব সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। গ্যালাক্সির আনাচে কানাচে।