বলুন মহামান্য রু।
শক্তির খরচ বেড়ে গিয়েছে কিলি। কোথায় যাচ্ছে এই শক্তি?
রবোটদের নূতন কপোট্রনকে চালু রাখার জন্যে এই শক্তিটুকুর প্রয়োজন।
রু হতচকিত হয়ে কিলির দিকে তাকাল, মনে হল তার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। কিলি নিচু গলায় বলল, আপনাকে বলেছি আমাদের নূতন কপোট্রনে প্রতিটি সেল এক মিলিয়ন সেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এই কাজটির জন্যে অনেক শক্তির প্রয়োজন। আমাদের মোট শক্তিক্ষয় বেড়েছে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ–
রু কিলিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি অত্যন্ত স্বার্থপরের মতো কথা বলছ কিলি। নিজেদের উন্নত করার জন্যে তুমি মহাকাশযানের এই দুষ্প্রাপ্য শক্তির অপচয় করবে?
কিলি কোনো কথা না বলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না কিলি, এটি কেমন করে হল? তোমাদের কপোট্রনে প্রথম যে কথাটি প্রবেশ করানো আছে সেটি হল এই মহাকাশযানকে রক্ষা করা। যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা। পশু যেরকম করে তার সন্তানদের রক্ষা করে তোমরা সেভাবে এই মহাকাশযানকে রক্ষা করবে!
আমি জানি মহামান্য রু।
তাহলে?
আমরা আমাদের আদেশ অমান্য করি নি মহামান্য রু।
শক্তির এই অপচয় আদেশ অমান্য নয়?
ব্যাপারটি একটু জটিল মহামান্য রু।
রু হঠাৎ করে উষ্ণ হয়ে বলল, তুমি বলতে চাইছ আমার বুদ্ধিমত্তা সেটা বোঝার জন্যে যথেষ্ট নয়? তোমার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজন?
আমি জানি আপনি ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নেবেন। সে জন্যে আমি খানিকটা প্রস্তুতি নিয়েছি মহামান্য রু।
কী প্রস্তুতি?
তার আগে মহামান্য ত্রা’কে আপনার কাছে আসার অনুমতি দিন। তিনি প্রস্তুত হয়েছেন।
দিচ্ছি। তাকে আসতে বল।
প্রায় সাথে সাথেই একটি দরজা দিয়ে ত্রা নিয়ন্ত্রণকক্ষটিতে প্রবেশ করে, এবং হঠাৎ করে সে বজ্রাহতের মতো স্থির হয়ে যায়–ঠিক একই সময় ঘরের অন্য একটি দরজা দিয়ে আরো একজন ত্ৰা এসে প্রবেশ করছে, সেও অপর তাকে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দুজন দুজনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কেউ নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রু প্রায় লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ত্রায়ের দিকে তাকিয়ে সে কিলির দিকে তাকাল, চিৎকার করে বলল, কী হচ্ছে এখানে কিলি?
কিলি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, এখানে একজন সত্যিকারের মহামান্যা ত্রা, অন্যজন আমার মতো একজন রবোট–তার মাথায় সর্বশেষ কপোট্রন লাগানো হয়েছে, মহামান্যা ত্রায়ের স্মৃতি সেখানে প্রবেশ করানো আছে।
কেন? রু চিৎকার করে বলল, এটা কোন ধরনের রসিকতা?
না মহামান্য রু, এটি রসিকতা নয়। এর নাম টুরিন টেস্ট।
টু–টুরিন টেস্ট? যে টেস্ট করে যন্ত্র এবং মানুষের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়?
কিলি মাথা নাড়ল, হ্যা মহামান্য রু। সেই বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ কম্পিউটারবিজ্ঞানী টুরিন বলেছিলেন, কীভাবে একটি যন্ত্রের মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা রয়েছে কি না পরীক্ষা করা যায়। এক ঘরে থাকবে যন্ত্র এক ঘরে মানুষ, তথ্য বিনিময় করে যদি যন্ত্রটিকে মানুষ থেকে আলাদা না করা যায় তাহলে বুঝতে হবে যন্ত্রটি মানুষের মতো বুদ্ধিমান–
আমি জানি।
এখানে সেই টুরিন টেস্টের আয়োজন করেছি মহামান্য রু। দুজনকে আলাদা দুই ঘরে না রেখে একই রকম চেহারায় আনা হয়েছে–এইটুকুই পার্থক্য।
কেন?
আমার ধারণা, আমরা যন্ত্রেরা শেষ পর্যন্ত মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা অর্জন করেছি মহামান্য রু। সেটি সত্যি কি না পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
রু বিস্ফারিত চোখে কিলির দিকে তাকিয়ে রইল। কিলি নরম গলায় বলল, আপনি যদি পরীক্ষাটি না করতে চান বলুন আমি রবোটটিকে সরিয়ে নিই। আমি জোর করে কিছু করতে চাই না।
রু হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের আতংক অনুভব করে। সেই সৃষ্টির আদিযুগ থেকে মানুষ ভিতরে ভিতরে এক ধরনের চাপা ভয়কে লালন করেছে, হয়তো সৃষ্টিজগতের কোথাও মানুষ থেকেও বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব রয়ে গেছে। এই কি সেই মুহূর্ত যখন মানুষ আবিষ্কার করবে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ নয়?
আপনি কি পরীক্ষাটি করতে চান? কিলি কোমল স্বরে বলল, বলুন মহামান্য রু।
ত্রা হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে বলল, না রু তুমি রাজি হোয়ো না। এই ভয়ংকর পরীক্ষায় তুমি রাজি হোয়ো না।
ঘরের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় ত্রা বলল, আমাদের একজন মানুষ অন্যজন রবোট?
কিলি মাথা নাড়ল, হ্যা!
আমরা নিজেরাও সেটি জানি না?
না।
যদি টুরিন টেস্ট করে রবোটকে আলাদা করা হয় তাহলে কী হবে?
কিলি কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রা কাতর গলায় বলল, কী হবে সেই রবোটের?
কিলি শীতল গলায় বলল, তাকে ধ্বংস করা হবে। পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে নি সেই বুদ্ধিমত্তার রবোটের কোনো প্রয়োজন নেই।
দুজন ত্ৰা বিস্ফারিত চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজেদের হাত চোখের সামনে তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করে। নিজের মুখে দেহে হাত বুলিয়ে দেখে। কিলি আবার ঘুরে তাকাল রুয়ের দিকে, বলল, আপনি কি শুরু করতে চান পরীক্ষাটি?
রু কোনো কথা না বলে কিলির দিকে তাকাল, সে প্রথমবার নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে শুরু করে। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।