তারেক একটু চুপ করে বলল, আমরা আমাদের যে জগৎ দেখছি তার মতো আরো অসংখ্য জগৎ আছে। সেগুলি একই সাথে পাশাপাশি যাচ্ছে বলে আমরা দেখতে পাই না।
পাশাপাশি?
হ্যাঁ। সময় পরিভ্রমণ করে আমরা নিজেদের জগতে যেতে পারি না, অন্য একটা জগতে চলে যাই।
জোয়ারদার মুখ অল্প হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কমবয়সী এই ছেলেটি যুগান্তকারী একটা পরীক্ষা করে পৃথিবীতে একটা ইতিহাস সৃষ্টি না করে থাকলে তিনি তার কথা হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু এখন কিছুই আর উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রফেসর জোয়ারদার আমতা আমতা করে বললেন, সেই জগৎ কি আমাদের এই জগতের মতো?
তারেক মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। কাছাকাছি জগৎগুলি আমাদের এই জগতের মতো। আমার ধারণা, কাছাকাছি জগৎগুলিতে আপনি রয়েছেন, আমি রয়েছি। আমি হয়তো একটু ভিন্ন ধরনের, আপনিও হয়তো একটু ভিন্ন।
তুমি–তুমি প্রমাণ করতে পারবে?
চেষ্টা করছি স্যার। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি ভবিষ্যৎ থেকে কিছু আনার। যদি আনতে পারি প্রমাণ হয়ে যাবে।
কীভাবে প্রমাণ হবে?
তারেক রহস্যের ভঙ্গিতে হেসে বলল, স্যার, সময় হলেই দেখবেন।
জোয়ারদার তার হাসি দেখে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন।
০৩.
সপ্তাহখানেক পর তারেক খুব উত্তেজিত হয়ে প্রফেসর জোয়ারদারের ঘরে ছুটে এল। বলল, সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে স্যার!
কী হয়েছে?
ভবিষ্যৎ থেকে কিছু জিনিস এনেছি।
কী জিনিস?
একটা স্কু ড্রাইভার, দুইটা ছোট আই.সি. আর–
আর কী?
আপনি বিশ্বাস করবেন না স্যার।
কী?
একটা খবরের কাগজের অংশ। ডেইলি হরাইজন।
জোয়ারদার ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারলেন না, একটু অস্বস্তি নিয়ে তারেকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারেক বলল, খবরের কাগজটা আগামী পরশুদিনের।
পরশুদিনের?
হ্যাঁ। এই দেখেন।
জোয়ারদার খবরের কাগজটা দেখলেন, সাদামাঠা কাগজ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এর মাঝে কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার থাকতে পারে। কিন্তু এটি সাদামাঠা কাগজ নয়, এই কাগজটি দুদিন পরে ছাপা হবে, দুদিন পরে কী কী ঘটবে সব এখানে লেখা রয়েছে। ভবিষ্যতের ছোট একটা অংশ এখানে চলে এসেছে। জোয়ারদার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তারেক বাধা দিয়ে বলল, আমার একটা জিনিস সন্দেহ হচ্ছে স্যার। সাংঘাতিক সন্দেহ হচ্ছে।
কী জিনিস?
তারেক আবার রহস্যের হাসি হেসে বলল, এখন বলব না স্যার, আগে প্রমাণ হাজির করি তখন বলব।
কী প্রমাণ হাজির করবে?
সময় হলেই দেখবেন।
তারেক ডেইলি হরাইজনের কিছু ফটোকপি করে মূল খবরের কাগজটি একটি খামে ভরে পোস্টঅফিসে নিয়ে নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করে পোস্ট করে দিল। কাগজটি যে দুদিন আগেই হাজির হয়েছে সেটা প্রমাণ করার এটা হবে খুব সহজ সর্বজনগ্রাহ্য প্রমাণ।
দুদিন পর যখন ডেইলি হরাইজন পত্রিকা বের হল, তারেক ভোরবেলাতেই কয়েকটা কপি নিয়ে এসে ল্যাবরেটরিতে বসল। দুদিন আগে পাওয়া খবরের কাগজটির ফটোকপি করে রাখা আছে, তার সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। মিলিয়ে কিছু বিচিত্র জিনিস দেখা গেল। যদিও খবরের কাগজ দুটি প্রায় একই রকম, হেডলাইন, মূল বিষয় সম্পাদকীয়, ছবি, বিজ্ঞাপন–সবকিছুই রয়েছে, তবুও খবরের কাগজ দুটি হুবহু একরকম নয়। এক–দুটি শব্দ অন্যরকম। এক–দুটি ছবি একটু ভিন্ন কোণ থেকে নেয়া। প্রায় একরকম হয়েও যেন একরকম নয়। তারেক বিজয়ীর মুখভঙ্গি করে বলল, দেখলেন স্যার? দেখলেন?
কী?
যে কাগজটা ভবিষ্যৎ থেকে এনেছি সেটা একটু অন্যরকম।
প্রফেসর জোয়ারদার মাথা চুলকে বললেন, তার মানে কী?
মানে বুঝতে পারছেন না? তারেকের গলায় একটু অধৈর্য প্রকাশ পেয়ে যায়, তার মানে এই খবরের কাগজটা এসেছে অন্য একটা জগৎ থেকে। আমি যেটা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই সত্যি। এখানে পাশাপাশি অনেক জগৎ রয়েছে, প্রায় একই রকম কিন্তু পুরোপুরি একরকম নয়। সময় পরিভ্রমণ করে আমরা এক জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যাই।
তার মানে তুমি বলতে চাও ঠিক আমাদের মতো আরো জগৎ রয়েছে, সেখানে আমি আছি, তুমি আছ?
নিশ্চয়ই আছে স্যার।
তারাও এটা নিয়ে রিসার্চ করছে?
নিশ্চয়ই করছে।
তারাও ভবিষ্যৎ থেকে জিনিসপত্র টেনে নিতে চেষ্টা করছে?
নিশ্চয়ই করছে। মাঝে মাঝে আমরা টুকটাক জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলি, কে জানে সেসব হয়তো অন্য কোনো জগৎ নিয়ে যায়।
তুমি তাই মনে কর?
হতেই তো পারে! কোনদিন না আবার আমাদের টেনে নিয়ে যায়! তারেক শব্দ করে হাসতে থাকে।
০৪.
প্রফেসর কাসেম জোয়ারদার ঠিক করলেন পাশাপাশি থাকা জগতের অস্তিত্ব নিয়ে তাদের হাতে যে প্রমাণটা রয়েছে সেটা প্রকাশ করার জন্যে একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকবেন। সবার সামনে খামটা খোলা হবে, দেখানো হবে দুদিন আগে কীভাবে খবরের কাগজটি চলে। এসেছে। তার চেয়ে বড় কথা খবরের কাগজটির মাঝে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য রয়েছে। ভবিষ্যৎ থেকে টেনে আনার চাইতেও এই পার্থক্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা প্রমাণ করে ভিন্ন জগতের অস্তিত্ব।
সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার আগে প্রফেসর জোয়ারদার তারেকের কাছ থেকে যন্ত্রপাতির ঘুঁটিনাটি বুঝে নিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে হঠাৎ করে কেউ কিছু প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করে ফেলতে পারে সেটা নিয়ে সতর্ক রইলেন। যন্ত্রপাতি কীভাবে চালায়, কীভাবে বন্ধ করে বারবার করে দেখে নিলেন।