তা ঠিক।
কিছু কিছু ড্রাগ বা নেশাজাত দ্রব্য আছে যেটা সাময়িকভাবে আপনাদের মস্তিষ্ককে বিকশিত করে–অনেকটা সেরকম। তবে আমাদেরটি সাময়িক নয়, আমাদেরটি স্থায়ী। অভ্যস্ত হতে খানিকটা সময় নেয়।
রু প্রায় এক শতাব্দী নিদ্রিত থাকা শরীরটিকে ধীরে ধীরে সজীবতা ফিরিয়ে আনতে আনতে বলল, তুমি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বলছ। মানুষের যেরকম ক্রমবিবর্তন হচ্ছে, তোমাদেরও হচ্ছে। তবে মানুষের ক্রমবিবর্তন খুব ধীরে ধীরে হয়, এক মিলিয়ন বছরে হয়তো অল্প কিছু পরিবর্তন হয়–তোমাদেরটা হয় খুব দ্রুত। গত এক শতাব্দীতেই তোমরা কপোট্রনের সেলদের যোগাযোগ প্রায় এক শ গুণ বাড়িয়ে ফেলেছ। ঠিক কি না?
ঠিক। তবে আমাদের এই উন্নতিটা জীবজগতের ক্রমবিবর্তন নয়, আমাদেরটি নিয়ন্ত্রিত, আমরা নিজেরাই করছি।
পজিটিভ ফিডব্যাক। নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তো?
কিলির প্রতিস্থাপিত রবোটটি শব্দ করে হাসল, কিছু বলল না।
রু তার আসনের পাশে পা নামিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কী বলে ডাকব?
আপনার আপত্তি না থাকলে আমাকে কিলি বলেই ডাকতে পারেন। কপোট্রন ভিন্ন হলেও আমি আসলে কিলিই।
না আপত্তি নেই। আপত্তি কেন থাকবে?
কারণ আমি দেখতে কিলির মতো নই। একটু অন্যরকম।
তাই নাকি? ক্যাপসুলটা খুলে দাও তোমাকে দেখি।
কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপসুলের ঢাকনা উঠে গেল, রু বাইরের তীব্র আলোতে নিজের চোখকে অভ্যস্ত হতে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। নগ্নদেহ নিও পলিমারের আবরণ দিয়ে ঢেকে সে ক্যাপসুল থেকে নেমে এল, কাছেই যে রবোটটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি নিশ্চয়ই কিলির প্রতিস্থাপিত রবোটটি। রু খানিকটা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে রবোটটির দিকে তাকিয়ে রইল, কী চমৎকার ধাতব শরীর, কপোট্রনটি মাথায় এমনভাবে বসানো হয়েছে যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে আশ্চর্য দেখার জন্যে তার নূতন দুটি চোখ অনেকটা মানুষের অনুকরণে তৈরী; হঠাৎ দেখলে মনে হয় জীবন্ত। রু বলল, তোমাকে দেখে মুগ্ধ হলাম কিলি।
মুগ্ধ হবার বিশেষ কিছু নেই। জীবন্ত প্রাণীর সাথে আমাদের মূল পার্থক্য হচ্ছে শক্তির ব্যবহার। আপনাদের শরীরে জৈবিক প্রক্রিয়ায় পরিপাকযন্ত্র দিয়ে শক্তি সংগ্রহ করেন, আপনাদের শরীরের বেশিরভাগ হচ্ছে তার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, যকৃত, পরিপাকযন্ত্র। আমাদের সেসব কিছুই লাগে না, শুধু দরকার একটা শক্তিশালী ব্যাটারি। তা ছাড়াও আপনাদের মস্তিষ্কের একটা বড় অংশ শরীরের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহার হয়, আমরা কপোট্রনের পুরোটা চিন্তাভাবনার কাজে ব্যয় করতে পারি। কাজেই বলতে পারেন, আমাদের দেহের ডিজাইন খুব সহজ। আমরা আপনাদের দেহের অনুকরণ করে যাচ্ছি।
খুব চমৎকার অনুকরণ করেছ।
ধন্যবাদ, মহামান্য রু।
তোমরা কত জন রবোটকে নূতন কপোট্রনে বসিয়েছ?
প্রায় সবাইকে। নূতন কপোট্রন তৈরি করতে অনেক সময় নেয়। পৃথিবীতে হলে খুব সহজ হত, এই মহাকাশযানের যন্ত্রপাতিগুলি একসাথে বেশি তৈরি করতে পারে না।
তা ঠিক।
আপনি কি বিশ্রাম নেবেন? না কাজ শুরু করে দেবেন?
রু হেসে বলল, এক শতাব্দী বিশ্রাম নিয়েছি, এখন কাজ শুরু করে দেয়া যাক। আমাকে সাহায্য করার জন্যে কাকে ঘুম ভাঙিয়ে আনছ?
ত্রা’কে। মহামান্যা ত্রা।
রু’র মন অকারণে খুশি হয়ে উঠল। এই মহাকাশযানে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ রয়েছে। মহাকাশযানের মূল্যবান রসদ বাঁচানোর জন্যে প্রায় সবাইকেই শীতলঘরে নিদ্রিত রাখা হয়। মাঝে মাঝে এক–দুজনকে নিদ্রা থেকে তুলে আনা হয়–মহাকাশযানের পুরো নিয়ন্ত্রণ, রসদপত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মহাকাশযান, এর ভিতরে যা আছে সেটা দিয়েই অনির্দিষ্টকাল তাদের বেঁচে থাকতে হবে। যে সমস্ত রবোটের দায়িত্বে এই মহাকাশযানটি মহাকাশের নিঃসীম শূন্যতার মাঝে দিয়ে অচিন্তনীয় গতিতে ছুটে চলছে। তাদের কার্যক্রম মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখতে হয়, তখন এক–দুজন মানুষকে ঘুম থেকে তোলা হয়। রু এই মহাকাশযানের আনুষ্ঠানিক দলপতি, তাই প্রতিবারই তাকে ঘুম থেকে জেগে উঠতে হয়। তাকে সাহায্য করার জন্যে একেকবার একেকজনকে জাগানো হয়। এবারে যে মেয়েটিকে জাগানো হচ্ছে তার জন্যে রুয়ের একটু গোপন দুর্বলতা রয়েছে। ত্রা মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী, অত্যন্ত খোলামেলা এবং অসম্ভব বুদ্ধিমতী। মহাকাশযানের রুটিনবাঁধা কাজের সময় কাছাকাছি এরকম একজন মানুষ থাকলে সময়টা চমৎকার কেটে যায়। রু মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কাছাকাছি যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, কখন আসবে ত্রা?
মহামান্যা ত্ৰা জেগে উঠেছেন। এখানে আসবেন কিছুক্ষণের মাঝেই।
নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেয়ালে বড় মনিটর, তথ্য সরবরাহ করার জন্যে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন, দুপাশে ডাটা ব্যাংকের ক্রিস্টাল। নিশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করলে একটা নিচু শব্দতরঙ্গের গুঞ্জন শোনা যায়। রু আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কাজ ক্ষু করে দিল। বাতাসের উপাদান, তার পরিমাণ, জলীয় বাষ্পের পরিমাণ, জৈব এবং অজৈব খাবারের পরিমাণ এবং উৎপাদনের হার দেখে রু মহাকাশযানের মোট শক্তির পরিমাণের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। মহাকাশযানের শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে। শক্তি এবং জ্বালানি এই মহাকাশযানের একমাত্র দুষ্প্রাপ্য উপাদান, এর অপচয় মহাকাশযানের সবচেয়ে বড় ত্রুটি। রু ভুরু কুঁচকে কিলির দিকে তাকাল, বলল, কিলি।