নিশি অবাক হয়ে দেখল তার শরীরের মাঝে মানুষটা হা হা করে হাসতে শুরু করেছে। হাসতে হাসতে সে অস্ত্রটা দেখিয়ে বলল, দেখেছ আমি একটা অস্ত্র যোগাড় করেছি? কী করব এই অস্ত্র দিয়ে শুনতে চাও? আমার মহাকাশযানে কী ঘটেছিল মনে আছে এখানেও তাই হবে। তবে এখানে কোনো ভুল হবে না। তুমি কী ভাবছ নিশি? এই অস্ত্র তুমি ফিরিয়ে দেবে? তোমাকে বলি আমি শুনে রাখ, আমার কাছে আরো অস্ত্র আছে, আমি লুকিয়ে রেখেছি এই মহাকাশযানে। যখন সময় হবে বের করে আনব।
নিশি কোনোভাবে টেবিলটা ধরে হতবাক হয়ে ভিডি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
পরবর্তী দুদিন নিশির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে রইল। মহাকাশযানের চিকিৎসা কেন্দ্রে তার শরীরের মাঝে কিছু বিচিত্র ধরনের বিষাক্ত জিনিস আবিষ্কার করা হল। তার নিদ্রাহীন বিশ্রামহীন দেহ পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। নিশিকে চিকিৎসা কেন্দ্রে। শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিতে হল দুই দিন। বিশ্রাম নিয়ে শরীরটি যখন মোটামুটিভাবে সুস্থ হয়ে এল তখন ক্যাপ্টেন জুক ফিরে এল আবার, এবারে আগের চাইতেও তীব্রভাবে, আগের চাইতেও নৃশংসভাবে।
ক্যাপ্টেন জুক এবারে নিশির দেহ নিয়ে ফিরে গেল অস্ত্রাগারে। নিজেকে অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে নিশি লিয়ারাকে জিম্মি করে নিয়ন্ত্রণ দখল করে নিল খুব সহজে। সে নির্বিচারে অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত, কিন্তু কেউ তাকে স্পর্শ করবে না সেটি সে খুব ভালো করে জানে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের সবরকম প্রবেশপথ বন্ধ করে সে মহাকাশযানের গতিপথ পাল্টানোর চেষ্টা করল, কাছাকাছি মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সাথে সংঘর্ষ ঘটানোর জন্যে ডাটাবেসে বিচিত্র সব তথ্য প্রবেশ করতে শুরু করল।
নিশি অবশ্য তার কিছুই জানল না। যখন সে জ্ঞান ফিরে পেল, সে নিজেকে আবিষ্কার করল নিয়ন্ত্রণকক্ষের গদিআঁটা নরম চেয়ারে। তার সামনেই আরেকটা চেয়ারে লিয়ারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। নিশি অবাক হয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে লিয়ারা?
লিয়ারা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল, তোমার সেটা জেনে কোনো লাভ নেই নিশি। তুমি বরং এসে আমাকে খুলে দাও।
নিশি উঠে দাঁড়াতেই তার মাথা হঠাৎ ঘুরে উঠল, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে টলতে টলতে সে লিয়ারার কাছে এগিয়ে যায়। তার সারা শরীরে এক বিচিত্র অসুস্থ অনুভূতি, মনে হয় এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। নিশি বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, কী হয়েছিল এখানে লিয়ারা?
ভিডি স্ক্রিনে তোমার জন্যে কিছু তথ্য রেখে গেছে ক্যাপ্টেন জুক।
নিশি টলতে টলতে ভিডি স্ক্রিনটা স্পর্শ করতেই সেখানে নিজেকে দেখতে পেল ভয়ংকর খ্যাপা একটা মানুষ হিসেবে। তীব্র স্বরে হিসহিস করে বলল, আবার আমি ফিরে গেলাম নির্বোধ আহাম্মক। তবে জেনে রাখ, এর পরেরবার যখন ফিরে আসব আমি আর ফিরে যাব না। তোমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে নিশি। জীবনের শেষ কয়টা দিন যদি পার উপভোগ করে নাও। তবে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি সেটি খুব সহজ হবে না। আমি তোমার শিরায় শিরায় নিহিলা বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছি–তুমি মারা যাবে না, কিন্তু প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তোমার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠবে, মনে হবে তোমার ধমনী দিয়ে গলিত সীসা বয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের সব চিকিৎসক মিলে যখন তোমাকে সুস্থ করে তুলবে তখন আমি ফিরে আসব সেই সুস্থ দেহে।
নিশি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল মানুষটা হা হা করে হাসতে শুরু করেছে খ্যাপার। মতো। সে হঠাৎ নিজে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছিল, লিয়ারা জাপটে ধরে তাকে দাঁড়া করিয়ে রাখল। কাতর গলায় ডাকল, নিশি, নিশি
বল লিয়ারা।
কী হবে এখন নিশি।
নিশি দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি ক্যাপ্টেন জুককে হত্যা করব লিয়ারা।
হত্যা করবে? ক্যাপ্টেন জুককে?
হ্যাঁ।
কিন্তু তুমি আর ক্যাপ্টেন জুক তো একই মানুষ।
তাতে কিছু আসে যায় না লিয়ারা। তবু আমি তাকে হত্যা করব। এন্ড্রোমিডার কসম।
***
চোখ খুলে তাকাল ক্যাপ্টেন জুক, আবার ফিরে এসেছে সে নিশির শরীরে। এবারে আর কেউ তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, এখন থেকে নিশির শরীরটি পুরোপুরি তার। কীভাবে অন্যের দেহে অনুপ্রবেশ করে তাকে দখল করতে হয় সেটা সে খুব ভালো করে জানে। কতবার করেছে সে! এক দেহ থেকে অন্য দেহে, সেখান থেকে আবার অন্য দেহে। জরাজীর্ণ দুর্বল বৃদ্ধের দেহ থেকে সুস্থ–সবল কোনো যুবকের দেহে। ক্যাপ্টেন জুক উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে আবিষ্কার করল তার হাতপা বিছানার সাথে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা। চমকে উঠে যাচকা টান। দিতেই টেবিলের হলোগ্রাফিক ভিডি স্ক্রিন চালু হয়ে উঠল। নিশির একটি পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক অবয়ব দেখতে পেল ক্যাপ্টেন জুক। শুনতে পেল নিশি মাথা বঁকিয়ে বলছে, শুভ সকাল ক্যাপ্টেন জুক। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমি নিশি। আমার জন্যে অনেকবার তুমি ভিডি স্ক্রিনে তথ্য রেখেছ এবারে আমি রাখছি। একটা দেহ যখন দুজন মানুষ ব্যবহার করে তখন কথা বলার আর অন্য উপায় কী?
ক্যাপ্টেন জুক, তুমি সম্ভবত তোমার হাতপায়ের বাঁধনকে টানাটানি করেছ, ভিতরে মাইক্রোসুইচ ছিল, সেটা এই ভিডি স্ক্রিনকে চালু করেছে। আমি সেভাবেই এটা প্রস্তুত করেছি। তুমি জেগে ওঠার পর আমি তোমার সাথে কথা বলব। হাতকড়াগুলি টেনে খুব লাভ হবে না। স্টেনলেস স্টিলে শতকরা পাঁচ ভাগ জিরকলাইট দিয়ে এটাকে বাড়াবাড়ি শক্ত করা হয়েছে। মানুষ যদি টাইরানোসোরাস রেক্সকে বেঁধে রাখতে চাইত সম্ভবত এই ধরনের কিছু ব্যবহার করত! কাজেই টানাটানি করে তুমি এটা খুলতে পারবে না। শুধু শুধু চেষ্টা করে লাভ নেই, আমি চাই তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোন।