আরো এক জন মানুষ? কী বলছ?
হ্যাঁ।
তোমার পুরো শরীর ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, বলা যেতে পারে তোমার মস্তিষ্কের একটা একটা নিউরন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
হ্যাঁ, কিন্তু সেই নিউরনে কী তথ্য রয়েছে সেটা পেরীক্ষা করে দেখা হয় নি। আমার ধারণা
তোমার ধারণা?
বিধ্বস্ত মহাকাশযানটাতে ক্যাপ্টেন জুক তার স্মৃতিটা জোর করে আমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
লিয়ারা শান্ত গলায় বলল, তুমি সেটা আগেও বলেছ নিশি, কিন্তু তুমি তো জান সেটি ঠিকভাবে করার মতো যন্ত্র পৃথিবীতে নেই। একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি রাখার মতো কোনো মেমোরি মডিউল নেই।
ক্যাপ্টেন জুকের মহাকাশযানে একটা অপরিচিত যন্ত্র ছিল, হয়তো সেটাই মানুষের মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কে স্মৃতি স্থানান্তর করে।
সেটি তোমার একটি অনুমান মাত্র।
কিন্তু আমার ধারণা আমার এই অনুমান সত্যি।
লিয়ারা ভয় পাওয়া চোখে বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?
আমি বুঝতে পারি।
বুঝতে পার?
হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মনে হয় ক্যাপ্টেন জুক মস্তিষ্কের ভিতরে আমার সাথে কথা বলে।
কথা বলে? লিয়ারা অবাক হয়ে বলল, কী বলে?
সে বের হয়ে আসতে চায়।
কেমন করে বের হয়ে আসতে চায়?
নিশি বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না।
লিয়ারা শংকিত দৃষ্টিতে নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নিশির মস্তিষ্কে যে ক্যাপ্টেন জুক রয়েছে এবং সে যে বের হয়ে আসতে চায় সেই কথাটির প্রকৃত অর্থ কী সেটা তার পরদিনই প্রকাশ পেল। নিয়ন্ত্রণকক্ষে নিশি আর লিয়ারা মিলে মূল সিস্টেমের একটা ত্রুটি সারাতে সারাতে হালকা কথাবার্তা বলছিল। সূক্ষ্ম একটি তার নির্দিষ্ট জায়গায় বসানোর জন্যে লিয়ারা নিশ্বাস বন্ধ করে রেখে কাজটি সেরে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষের ডিজাইনটি ঠিক নয়।
নিশি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, কেন ঠিক নয়?
এই যেমন মনে কর নিশ্বাস নেয়ার ব্যাপারটা। প্রায় প্রতি সেকেন্ডে আমাদের একবার নিশ্বাস নিতে হয়। কী ভয়ানক ব্যাপার!
নিশি হেসে বলল, তুমি নিশ্বাস নিতে চাও না?
আমি চাই কি না চাই সেটা কথা নয়, বেঁচে থাকতে হলে আমাকে নিশ্বাস নিতেই হবে, আমার সেখানেই আপত্তি।
লিয়ারার কথার ভঙ্গিতে নিশি শব্দ করে হেসে ফেলল, বলল, তোমার আর কিসে কিসে আপত্তি বল দেখি!
লিয়ারা মুখ শক্ত করে বলল, তুমি আমার কথার সাথে একমত হবে না?
নিশি কিছু একটা বলার জন্যে লিয়ারার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু না বলে বিচিত্র এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সে তার মেরুদণ্ড সোজা করে শক্ত হয়ে বসল। লিয়ারা অবাক হয়ে দেখল নিশির চেহারা কেমন যেন পাল্টে গেছে, তার চোখেমুখে হাসিখুশির ভাবটি নেই, সেখানে কেমন যেন অপরিচিত কঠোর একটি ভাব চলে এসেছে। লিয়ারা শংকিত গলায় বলল, নিশি, কী হয়েছে তোমার?
নিশি খুব ধীরে ধীরে লিয়ারার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টি কঠোর। সে কঠিন গলায় বলল, আমি নিশি নই।
তুমি কে?
আমি জুক। ক্যাপ্টেন জুক।
জুক?
হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত আমি বের হয়েছি। নিশি তার হাত চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, আমার হাত। শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, আমার শরীর!
লিয়ারা ভয় পাওয়া গলায় বলল, নিশি! নিশি–তোমার কী হয়েছে নিশি?
নিশি ক্রুদ্ধ চোখে লিয়ারার দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলল, আমি নিশি নই।
লিয়ারা ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল, সাথে সাথে নিশিও উঠে দাঁড়িয়ে খপ করে লিয়ারার হাত ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
লিয়ারা কাতর গলায় বলল, নিশি! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
না। নিশি বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে বলল, কিন্তু চিনতে কতক্ষণ? এস। আমার কাছে এস।
লিয়ারা প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে মুক্ত করে ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। লিয়ারার কাছে খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই রুহান এবং অন্যেরা এসে আবিষ্কার করল নিশি দুই হাতে তার মাথা ধরে টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রুহান নিশির কাছে গিয়ে। ডাকল, নিশি।
নিশি সাথে সাথে মাথা তুলে তাকাল। বলল, কী হল রুহান?
তোমার কী হয়েছিল?
আমার? আমার কী হবে?
তুমি নিজেকে ক্যাপ্টেন জুক বলে দাবি করছিলে কেন?
মুহূর্তে নিশির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রক্তশূন্য মুখে বলল, করেছিলাম নাকি?
লিয়ারা কাছে এসে নিশির হাত স্পর্শ করে বলল, হ্যাঁ, নিশি করেছিলে।
নিশি দুই হাতে নিজের চুল খামচে ধরে বলল, আমি জানতাম! আমি জানতাম!
কী জানতে?
আমার মাঝে সেই শয়তানটা ঢুকে গেছে। এখন সে বের হতে শুরু করেছে! কী হবে এখন?
রুহান নিশির কাঁধ ধরে একটা ছোট আঁকুনি দিয়ে বলল, তুমি শুধু শুধু ঘাবড়ে যাচ্ছ নিশি। মহাকাশযানের ডাটাবেসে অন্তত এক ডজন মনোবিজ্ঞানী আছে! এখানকার চিকিৎসকদের নিয়ে তারা কয়েকদিনে তোমার সমস্যা সারিয়ে তুলবে।
নিশি অবশ্যি কয়েকদিনে সেরে উঠল না, দ্বিতীয়বার তার ভিতর থেকে ক্যাপ্টেন জুক বের হয়ে এল তিন দিন পর। নিশি ব্যাপারটা টের পেল পরদিন ভোরবেলা, নিজেকে হঠাৎ করে আবিষ্কার করল মহাকাশযানের ডকিং বে’তে। রাতের পোশাক পরে সে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে কেন এসেছে, কীভাবে এসেছে সে জানে না। নিশি শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে ফিরে এসে আবিষ্কার করল তার পুরো ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। মনে হয় কেউ একজন ইচ্ছে করে সেটি তছনছ করে রেখেছে, মানুষটি কে হতে পারে বুঝতে তার দেরি হল না। মাথার কাছে ভিডি সেন্টারে কেউ একজন তার জন্যে একটা ভিডিও ক্লিপ রেখে গেছে।