লিয়ারা তার মনিটরে কিছু দুর্বোধ্য সংখ্যা প্রবেশ করাতে করাতে বলল, তুমি সেটা হয়তো মুখে বল নি, কিন্তু সেটাই বোঝাতে চেয়েছ।
নিশি এবারে শব্দ করে হেসে বলল, লিয়ারা, তুমি দেখেছ, তোমার সাথে কথা বলা আজকাল কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কেন?
আমি একটা জিনিস না বললেও তুমি ধরে নাও আমি সেটা বলতে চেয়েছি। কয়দিন পরে ব্যাপারটা হয়তো আরো গুরুতর হবে, কিছু একটা বলতে না চাইলেও তুমি ধরে নেবে আমি অবচেতন মনে সেটা বলতে চাই। আমি আগেই বলে রাখছি লিয়ারা, শুধুমাত্র যেটা আমি সচেতনভাবে করব তার দায়–দায়িত্ব আমি নেব।
নিশির কথা শুনে লিয়ারা তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে নিশি হঠাৎ বুকের ভিতরে এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করে। লিয়ারা সম্ভবত সাদাসিধে একটি মেয়ে, তার কুচকুচে কালো চুল, বাদামি চোখ, মসৃণ ত্বক–সবই হয়তো খুব সাধারণ, কিন্তু তাকে দেখে সব সময়েই নিশি নিজের ভিতরে এক ধরনের ব্যাকুলতা অনুভব করে। মেয়েটির চেহারায়, কথা বলার ভঙ্গিতে বা চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা রয়েছে যেটি নিশিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। নিশি প্রাণপণ চেষ্টা করে তার মনের ভাবকে লিয়ারার কাছে গোপন রাখতে, কিন্তু মানুষ অত্যন্ত রহস্যময় একটি প্রাণী, কিছু কিছু জিনিস না চাইলেও প্রকাশ হয়ে যায়। লিয়ারার কাছে সেটা প্রকাশ হয়ে থাকলে নিশি খুব অবাক বা অখুশি হবে না।
নিশি লিয়ারাকে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মনিটরে একটা লাল বাতি কয়েকবার জ্বলে উঠল এবং সাথে মহাকাশযানের দলপতি রুহানের অবিন্যস্ত চেহারাটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। রুহান বাম হাতে নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, নিশি, শুনেছ, কক্ষপথের কাছাকাছি একটা বিপদে পড়া মহাকাশযানের সিগনাল আসছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। চার মাত্রায় সংকেত।
নিশি শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, সর্বনাশ! চার মাত্রা হলে তো অনেক বড় বিপদ!
হুঁ। রুহান নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, অনেক বড় বিপদ।
কী করতে চাও এখন?
রুহান দীর্ঘদিন থেকে মহাকাশে মহাকাশে সময় কাটিয়ে এসেছে বলেই কি না কে জানে সমস্ত জগৎসংসারের প্রতি তার একটা বিচিত্র উদাসীনতা জন্ম হয়েছে। সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী করতে চাই যদি জিজ্ঞেস কর তাহলে বলব কিছু হয় নি এরকম ভান করে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে যেতে চাই।
নিশি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো করতে পারবে না। আসলে কী করবে?
কী করব যদি জিজ্ঞেস কর তাহলে বলব আমাদের একটা স্কাউটশিপ পাঠাতে হবে।
স্কাউটশিপ?
হ্যাঁ।
তার মানে আমাকে যেতে হবে?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, স্কাউটশিপ নিয়ে ভরসা করতে পারি এই মহাকাশযানে সেরকম মানুষ তুমি ছাড়া আর কে আছে বল।
নিশি একটা নিশ্বাস ফেলল। মহাকাশচারীর জীবনে এটাই হচ্ছে নিয়ম। বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি না নিয়ে বিশাল একটি দায়িত্ব নেয়া। অসংখ্যবার করে করে অভ্যাস হয়ে গেছে, আজকাল আর সে অবাকও হয় না।
রুহান বলল, আমি জানি একেবারেই শুধু শুধু যাওয়া হচ্ছে, মহাকাশযানটিতে কেউ বেঁচে নেই।
কেমন করে জান?
যেসব সংকেত এসেছে তাতে মনে হচ্ছে এটা অক্ষের উপর ঘুরছে না অর্থাৎ ভেতরে কৃত্রিম মহাকর্ষ নেই। জীবিত মানুষ থাকলে মহাকর্ষ থাকবে না এটা তো হতে পারে না।
তা ঠিক।
ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে নিশি প্রস্তুত হয়ে নেয়। বিধ্বস্ত মহাকাশযানটির কাছাকাছি যেতে কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টার মতো লেগে যাবে, ফিরে আসতে আরো চব্বিশ ঘণ্টা। মহাকাশচারীদের জীবনের জন্যে এটি এমন কিছু বেশি সময় নয়, কিন্তু তবুও অনেকেই স্কাউটশিপের কাছে তাকে বিদায় জানাতে এল। স্কাউটশিপের প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করে ইঞ্জিন চালু করার জন্যে যখন মূল প্রবেশপথ বন্ধ করতে যাচ্ছে তখন লিয়ারা উঁকি দিয়ে বলল, নিশি।
কী হল লিয়ারা?
সাবধানে থেকো।
নিশি চোখ মটকে বলল, থাকব লিয়ারা।
***
বিধ্বস্ত মহাকাশযানের ডকিং বে’তে স্কাউটশিপটা নামিয়ে নিশি কিছুতেই প্রবেশপথ উন্মুক্ত করতে পারল না। মহাকাশযানের মূল সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে তাকে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হল। প্রবেশপথের কিছু অংশ লেজার দিয়ে কেটে শেষ পর্যন্ত তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে হল, যার অর্থ ভিতরে কোনো জীবিত মানুষ নেই। নিশি গোলাকার প্রবেশপথ দিয়ে ভেসে ভেসে মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষের দিকে যেতে থাকে। রুহানের অনুমান সত্যি, মহাকাশযানটি তার অক্ষে ঘুরছে না, ভিতরে কৃত্রিম মহাকর্ষ নেই। নিশি ভেসে ভেসে করিডোর ধরে যেতে যেতে আবিষ্কার করে, ভিতরে তুলকালাম কিছু কাণ্ড ঘটে গেছে। মহাকাশযানের পুরোটি বিধ্বস্ত হয়ে আছে, জায়গায় জায়গায় বিস্ফোরণের চিহ্ন, আগুনে পোড়া কালো যন্ত্রপাতি ইতস্তত ভাসছে। দেয়ালে ফাটল, বাতাসের চাপ অনিয়মিত। নিয়ন্ত্রণকক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে সে একাধিক মৃতদেহকে ভেসে বেড়াতে দেখল, সেগুলিতে ভয়ানক আঘাতের চিহ্ন, দেখে মনে হয়, এই মহাকাশযানে কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। নিশি সাবধানে তার পায়ের সাথে বাধা স্বয়ংক্রিয় এটমিক ব্লাস্টারটি তুলে নিল, ভিতরে হঠাৎ করে কেউ আক্রমণ করতে চাইলে তাকে প্রতিহত করতে হবে।
নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বের হয়ে নিশি বড় করিডোর ধরে ভাসতে ভাসতে মহাকাশযানের দলপতির ঘরটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। ঘরটির দরজা বন্ধ ছিল, হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই খুলে গেল। ভিতরে আবছা অন্ধকার, তার মাঝে নিশির মনে হল দেয়ালের কাছে কোনো একজন মানুষ ঝুলে আছে। নিশি পায়ে ধাক্কা দিয়ে কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল একজন মানুষ নিজেকে দেয়ালের সাথে বেঁধে ঝুলে রয়েছে, মানুষটি এখনো জীবিত। নিশি চমকে উঠে বলল, কে? কে ওখানে?