মানুষটি হতচকিতের মতো নিয়ানার দিকে তাকিয়ে রইল। নিয়ানা নিচু কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, আমরা এর মাঝে অসংখ্য শিশুর জন্ম দিয়েছি। তারা বড় হলে আরো অসংখ্য শিশুর জন্ম হবে। তারা জন্ম দেবে আরো শিশুর, পৃথিবী থেকে সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস হবে না– সেটি বরং আরো নূতন করে গড়ে উঠবে।
কিন্তু সেখানে থাকবে শুধু নারী?
হ্যাঁ। একজন পুরুষ অন্য একজন মানুষকে জন্ম দিতে পারে না, কিন্তু একজন নারী পারে। কারো সাহায্য না নিয়ে সে একা আরেকজনকে জন্ম দিতে পারে। তাই নারী হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি। পুরুষ বাহুল্য। সৃষ্টিজগৎ থেকে আমরা সেই বাহুল্যকে দূর করে দিচ্ছি।
মানুষটি কাতর গলায় বলল, তুমি এ কী বলছ? সারা পৃথিবীতে থাকবে শুধু নারী? এক নারীর ক্লোন থেকে জন্ম নেবে অন্য নারীর ক্লোন?
হ্যাঁ।
কিছু পুরুষ তোমার সাথে নৃশংসতা করেছে বলে তুমি পৃথিবী থেকে সমস্ত পুরুষ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছ?
না। নিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, তুমি ভুল বুঝো না। আমার সাথে নিষ্ঠুরতার এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সাথে নিষ্ঠুরতা করেছে বলে আমার এটা উপলব্ধি হয়েছে, সৃষ্টির এই রহস্যটি আমি বুঝতে পেরেছি এর বেশি কিছু নয়। পুরুষের ওপরে আমার কোনো ক্রোধ নেই। অনুকম্পা আছে।
নিয়ানা তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। উবু হয়ে বসে থাকা মানুষটিকে ঘিরে দাঁড়ানো মেয়েগুলিকে বলল, একে নিয়ে যাও তোমরা। এ হচ্ছে পৃথিবীর শেষ পুরুষমানুষ। এর প্রতি করুণাবশত তোমরা চেষ্টা কোরো তার মৃত্যুটি যেন হয় যন্ত্রণাহীন।
মেয়েগুলি মাথা নাড়ল, একজন বলল, আমরা চেষ্টা করব মহামান্য নিয়ানা।
নিয়ানা দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পেল পৃথিবীর শেষ পুরুষমানুষটি মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে, তাকে ঘিরে রেখেছে সশস্ত্র মেয়েরা। এই মানুষটির দেহে রয়েছে শেষ ওয়াই ক্রমোজম, পৌরুষত্বের বীজ। কিছুক্ষণ পর এই পৃথিবীতে আর একটি ওয়াই ক্রমোজমও থাকবে না।
নিয়ানা নিশ্বাস ফেলে ভাবল, সেই পৃথিবী নিশ্চয়ই হবে ভালবাসার কোমল একটি পৃথিবী।
ক্যাপ্টেন জুক
নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেয়ালে লাগানো বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে নিশির হঠাৎ নূতন করে মনে হল যে মহাকাশচারীর জীবন প্রকৃতপক্ষে খুব নিঃসঙ্গ হতে পারে। শৈশব এবং কৈশোরে মহাকাশ অভিযান নিয়ে নিশির এক ধরনের মোহ ছিল, প্রথম কয়েকটি অভিযানে অংশ নিয়েই তার সেই মোহ কেটে যায়। সে আবিষ্কার করেছিল মহাকাশ অভিযান প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত কঠোর কিছু নিয়মকানুন দিয়ে বাঁধা অত্যন্ত কঠিন একটি জীবন। যদিও মহাকাশযানের বাইরে অসীম শূন্যতা, কিন্তু মহাকাশচারীদের থাকতে হয় ক্ষুদ্র পরিসরে। তাদের আপনজন যন্ত্র এবং যন্ত্রের কাছাকাছি কিছু মানুষ, তাদের বিনোদন অত্যন্ত জটিল কিছু যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাদের সঙ্গীত শক্তিশালী ইঞ্জিনের নিয়মিত গুঞ্জন। প্রথম কয়েকটি অভিযান শেষ করেই নিশি পৃথিবীর প্রচলিত জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সেখানে। গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে–তার অনুপস্থিতিতে পৃথিবীতে অর্ধ শতাব্দী কেটে গিয়েছে। তার পরিচিত মানুষের কেউ পৃথিবীতে নেই। যারা আছে তাদের কথাবার্তা, চাল–চলন মনে হয়। অপরিচিত, তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি গেলে নিজেকে মনে হয় অনাহূত। পৃথিবীর জীবনকে নিশির মনে হয়েছে দুঃসহ, আবার তখন সে মহাকাশচারীর জীবনে ফিরে এসেছে।
নিশি জানে এই জীবনেই সে বাঁধা পড়ে গেছে, মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে শুনতে একদিন সে আবিষ্কার করবে তার চুল ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে, মুখের চামড়ায় বয়সের বলিরেখা–দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। তখন মহাকাশচারীর পরীক্ষায় বাতিল হয়ে কোনো এক উপগ্রহের অবসরকেন্দ্রে কৃত্রিম জোছনাতে বসে বসে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। নিশি নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–ঠিক তখন তার পাশে লিয়ারা এসে বসেছে, সে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের একজন পরিচালক। নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর নিশি? তুমি এতবড় একটি দীর্ঘশ্বাস কেন ফেললে?
লিয়ারার প্রশ্ন শুনে নিশি হেসে ফেলল, বলল, সাধারণ নিশ্বাসে অক্সিজেন যদি অপ্রতুল হয়, তখন দীর্ঘ নিশ্বাসের প্রয়োজন। ব্যাপারটি একটি জৈবিক ব্যাপার, তুমি সত্যি যদি জানতে চাও শরীররক্ষা যন্ত্রের সাথে কথা বলতে পারি।
লিয়ারা মাথা নেড়ে বলল, মহাকাশচারী না হয়ে তোমার এটর্নি হওয়া উচিত ছিল।
নিশি হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। এতদিনে তাহলে হয়তো কোনো একটা উপগ্রহ কিনে ফেলতে পারতাম। তোমার কী খবর বল?
লিয়ারা হাসিমুখেই বলল, খবর বেশি ভালো না।
কেউ যদি হাসিমুখে বলে খবর ভালো নয় তাহলে সেটি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেয়ার কথা নয়, নিশিও নিল না। বলল, সব খবর যদি ভালো হয় জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়।
তোমার পক্ষে বলা খুব সহজ। তোমাকে তো আর মান্ধাতা আমলের একটা প্রোগ্রামকে পালিশ করতে হয় না। তুমি জান মূল সিস্টেমে দুটি চার মাত্রার ক্রটি বের হয়েছে?
তাই নাকি? নিশি হাসতে হাসতে বলল, ভালোই তো হল। তোমরা কয়েকদিন এখন কাজকর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকবে।
লিয়ারা চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি সত্যিই মনে কর আমরা এমনিতে কোনো কাজকর্ম করি না?
নিশি হাত তুলে বলল, না, না, না। আমি কখনোই সেটা বলি নি।