মানুষটির সামনে একটা উঁচু চেয়ারে একটি মেয়ে বসে আছে, সাদা কাপড় দিয়ে তার মুখ ঢাকা। মেয়েটি তার মুখের কাপড় খুলে বলল, আমার দিকে তাকাও।
মানুষটি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠে চোখ নামিয়ে ফেলল। মেয়েটি সাদা কাপড় দিয়ে মুখটি ঢেকে ফেলে বলল, আমার নাম নিয়ানা। ছয় বছর আগে তিন জন মানুষ আমার এই অবস্থা করেছে। কোনো কারণ ছিল না, তারা এটা করেছে শুধু আনন্দ করার জন্যে। পেট্রোল ঢেলে আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা হা হা করে হেসেছে। আমাকে গুলি করার আগে বলেছে, পৃথিবীতে এখন কোনো আইন নেই। আনন্দ করার জন্যে তারা যেটা করবে সেটাই হচ্ছে আইন। আমি জানতাম না মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ হয়। আমি জানতাম না নিষ্ঠুরতার মাঝে এত আনন্দ থাকে।
নিয়ানার সামনে মানুষটি মাথা নিচু করে বসে রইল। নিয়ানা একটা নিশ্বাস নিয়ে মাথা এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার মরে যাবার কথা ছিল। বুকের মাঝে দুটি বুলেট নিয়ে কেউ বেঁচে থাকে না। কোনো ডাক্তার আমাকে চিকিৎসা করে নি, কোনো হাসপাতালে আমাকে নেয়া হয় নি, তবু আমি মরি নি। ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আমি তখন নিশ্চিত হয়েছি, ঈশ্বরের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
নিয়ানা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান সেই উদ্দেশ্য কী?
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, না।
ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করেছেন। কারণ তিনি চান আমি এই পৃথিবীকে একটি সুন্দর পৃথিবীতে পাল্টে দিয়ে যাই–যে পৃথিবীতে কোনো নিষ্ঠুরতা থাকবে না, কোনো হিংস্রতা থাকবে না, ভায়োলেন্স থাকবে না। যে পৃথিবী হবে শান্ত সুন্দর কোমল একটি পৃথিবী। ভালবাসার পৃথিবী। কেমন করে হবে সেটি তুমি জান?
মানুষটি মাথা নাড়ল, না, জানি না।
পৃথিবী থেকে সকল পুরুষমানুষকে সরিয়ে দিয়ে। কারণ পুরুষমানুষের মাঝে রয়েছে এক ধরনের ভায়োলেন্সের বীজ। তাদের ওয়াই ক্রমোজমে নিশ্চয়ই রয়েছে সেই ভায়োলেন্সের জিনস। অন্যায় আর অবিচারের জিনস। তুমি জান প্রকৃতির কোনো খেয়ালে যদি কারো দেহে বাড়তি আরো একটি ওয়াই জিনস থাকত তাহলে কী হত?
কী হত?
সেই মানুষ হত বড় অপরাধী। পৃথিবীতে যখন মানুষ বেঁচে ছিল তখন জেলখানায় অপরাধীদের গবেষণা করে এই তথ্য বের হয়েছিল। শরীরে একের অধিক ওয়াই জিনস থাকলে তার অপরাধী হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীদের সেটা নিয়ে দ্বিমত ছিল আমার কোনো সন্দেহ নেই। পুরুষমাত্রই নৃশংস এবং নিষ্ঠুর। সমাজে বেঁচে থাকার জন্যে তারা সেটাকে চেপে রাখে। কেউ বেশি কেউ কম। যদি আইনের ভয় না থাকে তাদের ভিতর থেকে সেই হিংস্র পশু বের হয়ে আসে।
না। মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, এটি সত্যি হতে পারে না। পুরুষমানুষ শুধু অন্যায় করেছে, নিষ্ঠুরতা করেছে–সেটি সত্যি হতে পারে না। তাদের মাঝে ভালো মানুষ আছে। মহৎ মানুষ আছে–
সব ভান। তাদের ভালোমানুষি এবং মহত্ত্ব হচ্ছে লোক দেখানো অভিনয়। তাদের হৃদয়ের ভিতরে লুকানো রয়েছে তাদের প্রকৃত রূপ। নিষ্ঠুরতা আর হিংস্রতা। আমার কথা যদি বিশ্বাস না কর তাহলে চারদিকে ঘুরে তাকাও। তোমার চারপাশে যেসব মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তাদের জিজ্ঞেস কর।
মানুষটি ভীত চোখে তার চারপাশের সবাইকে দেখে মাথা নিচু করল। নিয়ানা তার। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, আমি ঘুরে ঘুরে সারা পৃথিবীর দুঃখী মেয়েদের একত্র করেছি। সংগঠিত করেছি। তাদের সশস্ত্র করেছি। তারপর সেই সশস্ত্র সংগঠিত মেয়েদের নিয়ে একটি একটি পুরুষকে হত্যা করে এই পৃথিবীকে জঞ্জালমুক্ত করেছি।
নিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ তীব্র গলায় বলল, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর শেষ পুরুষমানুষ। তোমার দেহে রয়েছে পৃথিবীর শেষ ওয়াই ক্রমোজম। তোমাকে শেষ করা হলে পৃথিবীর শেষ ওয়াই ক্রমোজম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই পৃথিবীতে আর কখনো কোনো পুরুষমানুষের জন্ম হবে না!
কিন্তু কিন্তু মানুষটি রক্তহীন মুখে বলল, শুধু যে পুরুষমানুষের জন্ম হবে না তা–ই নয়, কোনো মানুষেরই জন্ম হবে না। সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন শিশুকে জন্ম নিতে হলে পুরুষ এবং নারী দুই–ই প্রয়োজন।
ভূল! নিয়ানা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ভুল বলেছ, সন্তানের জন্ম দিতে পুরুষের প্রয়োজন হয় না, শুধুমাত্র মেয়ের প্রয়োজন। তুমি দেখতে চাও?
মানুষটি অবাক হয়ে নিয়ানার কাপড়ে ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নিয়ানা হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই ভেতর থেকে একটি নবজাতক শিশুকে বুকে ধরে উনিশ–বিশ বছরের একটি মেয়ে বের হয়ে এল। নিয়ানা শিশু এবং তার মাকে দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। সবচেয়ে শাশ্বত দৃশ্য। মায়ের বুকে শিশু। দৃশ্যটি সত্যিকারের শাশ্বত হয়ে যায় যখন সেই শিশুটি হয় একটি মেয়েশিশু।
নিয়ানার সামনে উবু হয়ে বসে থাকা হাতবাধা মানুষটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে নিয়ানার দিকে তাকিয়ে রইল। নিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, এই মায়ের গর্ভে এই শিশুটির জন্ম হয়েছে। সুস্থ সবল প্রাণবন্ত একটি শিশু। কোনো পুরুষের সাহায্য ছাড়া এই শিশুর জন্ম হয়েছে। মায়ের শরীরের একটি কোষ থেকে তার ছেচল্লিশটি ক্রমোজম আলাদা করে তার ডিম্বাণুতে প্রবেশ করিয়ে তার গর্ভেই বসানো হয়েছে। অনেক পুরোনো পদ্ধতি। এর নাম হচ্ছে ক্লোনিং। মানুষের ক্লোন করতে পুরুষমানুষের প্রয়োজন হয় না।