আমরা চারজনই একসাথে চিৎকার করে কথা বলেছি তাই মিঠুন কারো কথাই শুনতে পেল না। সে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঝুম্পা আমাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা তোর পুরা লম্বা স্টোরি শুনতে চাই।”
ঝুম্পা খেয়ালও করল না সে মিঠুন নামের এই নতুন ছেলেটাকে হঠাৎ করে তুই বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমাদের সাথে যেহেতু থাকবে আগে হোক আর পরে হোক তুই করে বলতেই হবে, তাই আমরা এখনই শুরু করে দিলাম, বললাম, “হ্যাঁ, তোর পুরা স্টোরি শুনতে চাই। দাড়ি কমা সহ।”
মিঠুন মনে হয় একটু ভ্যাবেচেকা খেয়ে গেল, বলল, “পুর স্টোরি?”
“হ্যাঁ।”
বগ বলল, “তোকে দেখে বোঝাই যায় না তুই আসলে এরকম ডেঞ্জারাস। আমরা ভেবেছিলাম তুই বুঝি ভ্যাবলা টাইপের।”
ফারা বলল, “আমি মোটেও ভাবি নাই ভ্যাবলা টাইপের। যে ছেলে চশমা পরে সে ভ্যাবলা টাইপ হতেই পারে না। তুই অনেক বই পড়িস না?”
“পড়ি। সায়েন্সের বই। সায়েন্স আর ম্যাথমেটিক্স।”
ফারা বলল, “দেখেই বুঝেছিলাম তুই জ্ঞানী টাইপ। আমাদের স্কুলেই কোনো জ্ঞানী টাইপ ছাত্রছাত্রী নাই। তুই হবি প্রথম।”
“প্রথম?”
ঝুম্পা বলল, “এবং শেষ।”
মিঠুন ভ্যাবেচেকা খেয়ে সবার দিকে তাকাল। বলল, “শেষ?”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম।
০৩. দাঁড়ি কমা সহ তার লম্বা স্টোরি
দুই দিন পর মিঠুন আমাদের স্কুলের পেয়ারাগাছের ডালে বসে দাঁড়ি কমা সহ তার লম্বা স্টোরিটা বলল। (এই পেয়ারাগাছটার মত কপাল খারাপ কোনো পেয়ারাগাছ পৃথিবীতে নাই। এই গাছে কোনো পেয়ারা কখনো বড় হতে পারে নাই–পেয়ারার মত দেখতে হওয়ার আগেই কেউ না কেউ খেয়ে ফেলেছে।) মিঠুন আগে কখনো গাছে ওঠেনি, একটা গল্প বলার জন্যে কেন পেয়ারাগাছে উঠতে হবে সেটাও সে প্রথমে বুঝতে পারেনি। নিচের থেকে ঠেলে এবং উপর থেকে টেনে তাকে পেয়ারাগাছে তুলতে হয়েছে। একবার আরাম করে বসার পর সে অবশ্যি স্বীকার করেছে গল্প বলার জন্যে এই জায়গাটার তুলনা নাই।
মিঠুনের গল্পে অনেক বৈজ্ঞানিক বকর বকর আছে যার কোনোটা আমরা কিছুই বুঝি নাই। বৈজ্ঞানিক বকর বকর বাদ দিলে গল্পটা এরকম :
আমার নাম মিঠুন, ভালো নাম কাজী রকিবুল আলম। আমার বাবার নাম কাজী জাহিদুল আলম। মা নুসরাত জাহান আমার দাদা কাজী জাহাঙ্গীর, দাদী জোবেদা খানম। আমার নানা–
(এ রকম জায়গায় আমরা মিঠুনকে থামালাম। তার দাদা দাদী নানা নানীর নাম জানলেও আমাদের ক্ষতি নাই। মিঠুন একটু অসন্তুষ্ট হল মনে হল। বলল, “তোমরা না একটু আগে বলেছ দাড়ি কমা সহ বলতে হবে। এখন যখন বলছি তখন বলতে দিচ্ছ না।” আমি বললাম, “দাদা দাদী নানা নানীর নাম, চাচা-চাচী, ফুপা-ফুপু-মামা-মামী কিংবা খালা-খালুর নাম দাড়ি কমার মাঝে পড়ে না। দাড়ি কমা সহ বলার অর্থ হচ্ছে গল্পটি বলার সময়
এরকম জায়গায় ঝুম্পা আমাকে ধমক দিয়ে বলল, “ইবু, তুই বকর বকর করবি না। চুপ করে দেখি।” কাজেই আমি চুপ করে গেলাম আর মিঠুন আবার শুরু করল।)
আমার বাসায় আমি ছাড়া আছে আমার আপু। আমার আপু হচ্ছে পারফেক্ট একজন মানুষ। লেখাপড়ায় ভাল, সব সাবজেক্টে জি.পি.এ ফাইভ, গান গাইতে পারে, নাচতে পারে, গলা কাপিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। ছবি আঁকতে পারে, ডিবেট করতে পারে। এমন কী ভালো ব্যাডমিন্টনও খেলতে পারে। বাসায় যখন কোনো গেস্ট আসে সে তাদের সাথে যতক্ষন দরকার মিষ্টি মিষ্টি করে কথাও বলতে পারে। আমার আব্দু আম্মু আমার বোনকে নিয়ে খুবই খুশী, আমাকে প্রত্যেকদিন কম করে হলেও দশবার করে বলে, “তোর বোন এতো ভালো আর তুই এরকম অপদার্থ বের হলি কেমন করে?”
(এরকম জায়গায় সবাই নিজেদের কথা বলতে শুরু করল, দেখা গেল সবার জীবনে মিঠুনের বড় বোনের মত কেউ একজন আছে যার কারণে তাদের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুধু আমায় কিছু বলতে হল না কারণ আমার সেরকম কেউ নাই, আমি একা। আমার সাথে আছে আমার বাবা যার আমাকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নাই।
সবাই নিজের দুঃখের কথা বলে পরিচিত অন্যান্যদের দুঃখের কথা বলতে শুরু করল তখন আমি ধমক দিয়ে বললাম, “তোরা ঘ্যানঘ্যান করা থামাবি? মিঠুনের কথাটা একটু শুনি?” তখন মিনি আবার শুরু করল।)
কথাটা ভুল না যে আমি মোটামুটি অপদার্থ। অংক আর বিজ্ঞান ছাড়া অন্য সব সাবজেক্টে গোল্লা পেতাম। আস্তে আস্তে আমি অংক আর বিজ্ঞানেও গোল্লা পেতে আরম্ভ করলাম তার কারণ পরীক্ষার খাতায় আমি যেটা লেখি সেটা স্যার আর ম্যাডামেরা বুঝতে পারে না। যেমন মনে কর পরীক্ষায় এসেছে অনু পরমানু কীভাবে তৈরী হয়। সবাই লিখেছে পরমানুর ভিতরে থাকে নিউক্লিয়াস বাইরে থাকে ইলেকট্রন এই সব হাবিজাবি। আমি লিখেছি কোয়ার্কের কথা। আপ ডাউন কোয়ার্ক আর তাদের এন্টি পার্টিকেল দিয়ে সবকিছু তৈরী হয়েছে। চার্জ হচ্ছে ফ্রাকশনাল–
(আমরা খুব অস্বস্তির সাথে আবিষ্কার করলাম এরকম জায়গায় মিঠুন তার গল্প বলার বদলে বিজ্ঞান নিয়ে বকর বকর করা শুরু করেছে। আমরা কিছুক্ষণ সহ্য করলাম, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম তারপর বাধ্য হয়ে ঝুম্পা মিঠুনকে থামাল। বলল, “মিঠুন, তোর বিজ্ঞানের ভ্যাদর ভ্যাদর শোনার জন্যে আমরা বসি নাই।”
“ভ্যাদর ভ্যাদর?” মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “ভ্যাদর ভ্যাদর বলে যে একটা শব্দ আছে সেইটাও আমি জানতাম না।”
ঝুম্পা বলল, “আছে। তুই এখন যেটা করছিস সেটা হচ্ছে ভ্যাদর ভ্যাদর। ভ্যদির ভ্যাদর ছাড়াও আরো ইন্টারেস্টিং শব্দ। আছে, তুই চাইলে তোকে শিখিয়ে দেব। এখন ভ্যাদর ভ্যাদর। করা বন্ধ করে তোর গল্পটা বল।”