ছেলেটা খুব গম্ভীরভাবে শিশিটা তার পকেটে রেখে বলল, “আমি তোমাদের আগেই বলেছিলাম, আমি জিনিষটা দেখাতে পারি কিন্তু জিনিষটা
কী সেটা বলতে পারব না।”
“জিনিষটাও তো দেখা গেল না।”
“দেখা না গেলে সেটা কী আমার দোষ?”
ঝুম্পা আমাকে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে ইবু, তোর আর ঝগড়া করতে হবে না। ধরে নে শিশিটাই হচ্ছে দেখার জিনিষ। শিশিটা তো দেখেছিস?”
আমি কিছু বললাম না। ছেলেটা বলল, “ক্লাস এইটটা কোনদিকে বলবে প্লীজ?”
ঝুম্পা বলল, “কোনো একটা ক্লাশ রুমে বসে যাও।”
মিঠুন নামের নতুন এই ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “কোনো একটা ক্লাশ রুমে বসে যাব মানে?”
“এই স্কুলে ক্লাশ রুমের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। স্যারেরা ক্লাশে আসে না। আসলেও পড়ায় না। তাই তুমি কোন ক্লাশে বস তাতে কিছু আসে যায় না। একেকদিন একটা ক্লাশে বসে দেখ কোনটা ভালো লাগে।”
আমি ভেবেছিলাম এই কথাটা শুনে ছেলেটা খুবই ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু সে মোটেও ঘাবড়ালো না, বরং তার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক!”
এবারে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক?”
“হ্যাঁ। আমি সব সময় এরকম একটা স্কুলে পড়তে চেয়েছিলাম যেখানে স্যার ম্যাডামেরা উৎপাত করবে না। আমরা নিজেরা নিজেরা ইচ্ছামতন লেখাপড়া করব।”
বগা বলল, “ইচ্ছামতন লেখাপড়া? কোনোদিন কোনো ছেলেমেয়ে ইচ্ছামতন লেখাপড়া করে? বেত দিয়ে না চাবকালে কেউ পড়তে চায়?”
মিঠুন তার চশমাটা ঠিক করে বলল, “কেউ কোনোদিন সেই এক্সপেরিমেন্ট করেছে? করে দেখলে বোঝা যাবে তোমার কথা সত্যি না মিথ্যা।”
মিঠুন তার গলার স্বর গম্ভীর করে বলল, “তুমি জান পৃথিবীর অনেক দেশে লেখাপড়ার মাঝে কোনো পরীক্ষা নাই।”
ফারা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি? সত্যি? কোন দেশ? আমাদেরকে সেই দেশে নিবে? আমরা সেই দেশ থেকে লেখাপড়া করে আসতে পারি?”
মিঠুন বলল, “সেইটা আমি জানি না। বড় না হওয়া পর্যন্ত তোমার কথা কোনোদিন কেউ শুনবে না।” মিঠুনের মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে যায়
সে মাথা নেড়ে বলল, “মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“মনে হয় যদি একটা টাইম মেশিন তৈরী করে এক ঘণ্টার মাঝে বড় হয়ে যেতে পারতাম।”
ফারা বলল, “কী মেশিন?”
“টাইম মেশিন।”
“সেইটা আবার কী?”
“যে মেশিন দিয়ে সময়ের আগে পিছে যাওয়া যায়।”
“সময়ের আগে পিছে যাওয়া যায়?” ফার ভুরু কুঁচকে বলল, “সেইটা আবার কীভাবে করবে?”
বগা মুখ শক্ত করে বলল, “অসম্ভব।”
মিঠুন বলল, “তাড়াতাড়ি বড় হওয়া খুবই সম্ভব। আইনস্টাইনের স্পেশাল রিলেটিভিতে পরিষ্কার বলা আছে। টাইম ডাইলেশান বলে একটা ব্যাপার আছে”।
মিঠুন তখন আরো কিছুক্ষণ বকর বকর করে বৈজ্ঞানিক কথা বলল যার একটা শব্দও আমরা বুঝতে পারলাম না। শুধু টের পেলাম এই ছেলেটা আজব। তাকে বেশী ঘাটানো ঠিক না, ঘাটালেই সে বৈজ্ঞানিক কথা বলে আমাদের মাথা খারাপ করে দেবে। আমি তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ঠিক করেছ কোন ক্লাশ রুমে তুমি বসতে চাও?”
মিঠুন বলল, “তোমরা যেখানে বসবে আজকে আমি সেখানে বসতে চাই।”
ফারা বলল, “ভেরি গুড়।”
মিঠুন জানতে চাইল, “কেন? ভেরি গুড কেন?”
“আমাদের ক্লাশে একজনও চশমা পরা ছেলে মেয়ে নাই। এখন একজন হয়েছে।”
মিঠুন মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না, ভুরু কুঁচকে ফারার দিকে তাকাল। ফারা বলল, “ক্লাশে চশমা পরা ছেলেমেয়ে থাকলে ক্লাশের একটা ভাব হয়। সেইজন্যে।”
আমরা যখন হেঁটে হেঁটে মিঠুনকে আমাদের ক্লাশ রুমে নিয়ে যাচ্ছি তখন সে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কোন ক্লাশে পড়?”
“এইট।”
“এইট?” শুনে মনে হল তার একটু মন খারাপ হল, সে ভাবছিল সে অন্য একটা ক্লাশে বসতে পারবে।
আমি বললাম, “মন খারাপ করো না। আমরা তোমাকে অন্য অন্য ক্লাশেও নিয়ে যাব।”
ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি এর আগে কোন স্কুলে ছিলে?”
“অক্সব্রীজ। অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।”
আমরা চারজন এক সাথে চিৎকার করে বললাম, “অক্সব্রীজ?”
“হ্যাঁ। কেন? কী হয়েছে?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না না, কিছু হয় নাই। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“তুমি অক্সব্রীজ থেকে মহব্বতজানে কেন এসেছ?”
“অক্সব্রীজ থেকে আমাকে টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছে।”
“টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছে? কেন?”
“সেইটা অনেক লম্বা স্টোরি।”
ঝুম্পা বলল, “বল তোমার স্টোরি। লম্বা স্টোরি ছোট করে বল।”
মিঠুন মাথা নাড়ল, “ছোট করে বললে তুমি বুঝবে না।”
“বুঝব। ঝুম্পা মুখ শক্ত করে বলল, “আমরা অনেক চালু। চোখের ঝিলিক দেখে আমরা মানুষের মুখের কথা বুঝে যাই।“ ঝুম্পা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে?”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, ঝুম্পার কথা সত্যি, চোখের ঝিলিক দেখে আমরা কথা বুঝে যাই।
মিঠুন বলল, “ঠিক আছে। তারপর কিছুক্ষণ উপর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর একজন একজন করে সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর আরেকটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার এক্সপরিমেন্টের জন্য যখন অক্সব্রীজ স্কুলের সায়েন্স বিল্ডিংটা উড়ে গেল—”
আমরা চিল্কার করে উঠলাম, “কী? কী বললে?”
বগা বলল, “তুমি সেই রহস্যময় ছেলে?”
ঝুম্পা বলল, “তুমি স্কুল বিল্ডিং উড়িয়ে দিয়েছ?”
ফারা বলল, “কেমন করে উড়িয়েছ?”
আমি বললাম, “আমাদেরটা উড়াবে? প্লীজ?”