মহব্বতজান স্কুলের কোনো ছিরি ছাদ নাই, কোনটা কোন ক্লাশ সেটা কোথাও লেখাও নাই। শুধু তাই না, ক্লাশ রুম গুলো সাজানোও নাই, ক্লাশ গ্রীয়ের পাশে ক্লাশ এইট, সেভেনে পাশে টেন এরকম। কেউ যদি না জানে কোনোভাবেই সে তার ক্লাশ খুঁজে পাবে না। আমাদের স্যার ম্যাডামেরাও খুঁজে পান না, তাই তারা মাঝে-মধ্যে ভুলভাল ক্লাশে এসে বসে থাকেন, কিন্তু তারা যেহেতু কোনো কিছু পড়ান না কারো কোনো সমস্যা হয় না। একবার জলীল স্যার আমাদের বেদম পিটাচ্ছিলেন, আমি স্পষ্ট শুনলাম স্যার বিড়বিড় করে বলছেন, “এতো বড় বড় ছেলেমেয়ে এখনো ক্লাশ ফ্রীতে পড়ে!” আমরা তখন ক্লাশ এইটে পড়ি।
যাই হোক ছেলেটাকে খুবই বিভ্রান্ত দেখা গেল, তখন হঠাৎ সে আমাদেরকে দেখতে পেল। সে আবার ডান হাতটা তার বুকের কাছে ধরে বুক পকেটের জিনিসটা পরীক্ষা করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি এসে চশমার ফাঁক দিয়ে আমাদেরকে এক নজর দেখে বলল, “ক্লাশ এইট কোনটা বলতে পার?”
বগা জিজ্ঞেস করল, “তুমি ক্লাশ এইটে পড়?”
ফারা বলল, “তোমাকে যে নামিয়ে দিলেন, উনি কী তোমার আম্মু? যা সুইট!”
ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
আমি বললাম, “তোমার পকেটে কী?”
ছেলেটা ঝট করে সোজা হয়ে গেল, তারপর কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বোঝাই যাচ্ছে পকেটে যে জিনিষটা আছে সেটার কথা সে কাউকে জানাতে চায় না। আমি ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা না বলে শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়েও কথা বলা যায়, আমি তখন চোখের দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটাকে বললাম, “আমি জানি তোমার পকেটে যে জিনিষটা আছে সেটা গোপন এবং মনে হয় বেআইনী। কিন্তু তোমার কোনো ভয় নাই, তুমি আমাদেরকে সেটা বলতে পার। আমরা কাউকে বলব না।”
ছেলেটি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে প্রথমে এক ধরণের ভয় দেখা গেল আস্তে আস্তে ভয়টা একটু কমে এল। তখন সে বগার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ক্লাশ এইটে পড়ি।” তারপর সে ঘুরে ফারার দিকে তাকাল, বলল, “হ্যাঁ আমার মা আমাকে নামিয়ে দিয়েছে। তারপর সে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল, সেটাকে একটা দীর্ঘশ্বাসের মত শোনাল। বলল, “সবার ধারণা আম্মু খুব সুইট আসলে আম্মুর মেজাজ খুবই গরম! আমাকে ঝাড়ি দেওয়া হচ্ছে আম্মুর হবি।” কথা শেষ করে সে ঝুম্পার দিকে তাকাল, বলল, “আমার নাম মিঠুন”। সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আমার পকেটে কিছু একটা আছে সেটা তুমি কেমন করে বুঝতে পেরেছ?”
আমি বললাম, “না বোঝার কি আছে? তোমার চালুক চুলুক ভাব দেখলেই বোঝা যায়।”
“চালুক চুলুক?”
“হ্যাঁ। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা বেআইনী জিনিষ আছে–লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছ।”
মিঠুন নামের ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ।” বলে সে শীষ দেওয়ার মত একটা শব্দ করল, আমি ভাবলাম এখন সে বলবে তার পকেটে কী আছে। কিন্তু সে বলল না চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী আছে তোমার পকেটে?”
ছেলেটা বলল, “আমি জিনিষটা তোমাদের দেখাতে পারি, কিন্তু জিনিষটা কী তোমাদের বলতে পারব না।”
“কেন?” “কারণ আমি জানি না জিনিষটা কী।”
“তুমি জান না কী কিন্তু জিনিষটা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
আমরা ছেলেটার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আমাদের সাথে যারা কথা বলে তাদের বেশির ভাগের কথারও মাথা মুণ্ডুও আমরা বুঝতে পারি না। আমরা কথা শোনার সময় শুধু মাথা নেড়ে যাই। অন্যেরাও আমাদের কথার মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারে না। আমরা একটা জিনিষ বলি তারা অন্য একটা জিনিষ বুঝে বসে থাকে। তাই চশমা পরা এই মূতন ছেলেটার কথা শুনে আমি বেশি অবাক হলাম না! সে পকেটে কী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখার আমার খুব কৌতূহল হল, তাই বললাম, “জিনিষটা দেখাও।”
ছেলেটা আমাদের সবার মুখের দিকে তাকাল তারপর থমথমে গলায় বলল “কাউকে কিন্তু এটার কথা বলতে পারবে না।”
“বলব না।”
“জিনিষটা অসম্ভব গোপন। এটার জন্যে আমার লাইফের সবকিছু ওল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।”
“ঠিক আছে।”
“তোমরা কিন্তু জিনিষটা নেয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি করবে না। আমি ধরে রাখব, তোমরা শুধু দেখবে।”
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, “ঠিক আছে বাবা! ঠিক আছে। বক্তৃতা শেষ করে এখন দেখাও।”
ছেলেটা এবারে খুব সাবধানে তার বুক পকেট থেকে কী একটা যেন বের করল, আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম জিনিষটা একটা ছোট শিশি। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মিষ্টি মিষ্টি ট্যাবলেট দেওয়ার জন্যে যেরকম ছোট শিশি থাকে অনেকটা সেরকম। শিশির ভিতরে কী আছে সেটা দেখার জন্যে আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম এবং দেখলাম কিছুই নাই। শিশিটা পুরোপুরি ফাঁকা।
জিজ্ঞেস করলাম, “কী আছে শিশির ভিতরে?”
“জানি না।”
বগা বলল, “কিছু তো নাই।”
“আছে।”
“তাহলে দেখা যায় না কেন?”
“জানি না।।
এবারে আমার সন্দেহ হল ছেলেটা নিশ্চয়ই আমাদের সাথে মশকরা করছে। চেহারা দেখে বোঝা যায় না আসলে সে নিশ্চয়ই খুবই ফাজিল টাইপের ছেলে, আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। আমি একটু গরম হয়ে বললাম, “তুমি আমাদের সাথে ফাজলেমী করছ?”
ছেলেটা খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলল, “না ফাজলেম করব কেন?”
“শিশিতে কিছু নাই, কিছু দেখা যায় না, কী আছে সেটা জান না, কেন দেখা যায় না সেটা জান না আবার বলছ আছে–এটা যদি ফাজলেমী না হয় তাহলে ফাজলেমী কী?”