মানুষটা ঘরের ভেতর হাঁটল, জানালায় দাড়িয়ে বাইরে তাকাল তারপর আবার হেঁটে টেবিলটার কাছে এসে চেয়ারে পা রেখে টেবিলটাতে বসল। তারপর মিঠুনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই মিঠুন।”
মিঠুন কোনো কথা বলল না।
মানুষটা মুখের মাঝে হাসি হাসি ভাব এনে বলল, “যার নামে বিখ্যাত মিঠুনিয়াম তৈরী হবে?”
আমরা চমকে উঠলাম, ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাকে মিঠুনিয়াম নাম দেওয়ার কথাটা বলেছিল ঝুম্পা, আমরা তখন ছিলাম আকাশে। এই মানুষ সেই কথা কেমন করে জানল? মানুষটা বলল, “আমার কিন্তু ব্লাকহোলের বাচ্চা নামটাই পছন্দ। এই নামটার মাঝে একটা ক্যারেক্টার আছে। ব্লা-ক-হো-লে-র বাচ-চা।” কথা শেষ করে মানুষটা হা হা করে হাসল। তখন দেখলাম তার মুখের ভিতর অনেকগুলো সোনার দাঁত, দেখে কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। মনে হয় এটা মানুষের মুখ না এটা রাক্ষসের মুখ।
মানুষটা হঠাৎ হাসি বন্ধ করে বলল, “ইউনিভার্সের নাইটি সিক্স পার্সেন্ট আমরা জানি না সেই লাইন্টি সিক্স পার্সেন্টকে টিপে তুমি ব্ল্যাকহোল বানিয়ে ফেলেছ–এটা কী সোজা কথা নাকী? তুমি তো অনেক কামেল মানুষ।”
ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে এসব কথা জেনেছেন?”
“আমি সব জানি।” মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, “এই দেশের কোথায় কী হয় কে কী কথা বলে কার সাথে কখন কী কথা বলে আমি সব জানি। এটা হচ্ছে আমার চাকরী।”
মিঠুন এই প্রথম একটা কথা বলল, “আপনি আমাদেরকে কেন ধরে এনেছেন?”
“তোমাদেরকে ধরে না আনলে কী এই রকম খোলামেলা কথা বলতে পারতাম?”
“আপনার সাথে তো আমাদের বলার কিছু নাই।”
“আছে।”
“কী কথা?”
“মিনিয়াম নামটা আমার পছন্দ না। আমার পছন্দ হচ্ছে জামশেদিয়াম। বুঝেছ? জামশেদিয়াম। কেন বুঝেছ?”
আমি বললাম, “আপনার নাম জামশেদ”
“হ্যাঁ। আমি মেজর জামশেদ। তোমাদের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা আসলে বাচ্চা কাচ্চার জিনিষ না। এটা হচ্ছে বড়দের জিনিষ। তাই এটা বড়দের হাতে থাকা ভাল। এটার নামও হওয়া উচিত বড়দের নামে। বুঝেছ?”
আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। জামশেদ নামের মানুষটা গম্ভীর মুখে বলল, “এখন এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলি। জিনিষটা খুব সহজে কীভাবে করা যায় বল দেখি?”
আমি বললাম, “এটা করা সম্ভব না। এটা মিঠুন আবিষ্কার করেছে এটা সবসময়ে মিঠুনের নামে থাকবে।”
মানুষটা আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে এরকম ভাব করে বলল, “ও আচ্ছা! তাই নাকী?”।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।”
“তোমার নামটা যেন কী? বগা নাকি ইবু?”
“ইবু।”
“শোনো ইবু–আমি বেয়াদপ ছেলে ছোকড়া পছন্দ করি না। বুঝেছ? এখন থেকে আমি পারমিশান না দিলে কোনো কথা বলবে না। শুধু শুনে যাবে। বুঝেছ?”
আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। জামশেদ নামের মানুষটা বলল, “আমি তোমাদের ফ্লাইং মেশিন তুলে নিয়ে এসেছি। এর ভিতরে আছে তোমাদের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা। দড়ি দিয়ে বাঁধা এই যন্ত্র খুলে সেই ব্লাকহোলের বাচ্চা বের করতে সময় লাগবে পনেরো মিনিট। কাজেই ধরে নাও ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা এখন আমার। আমি এখন তোমাদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। কেন বের করছি না বল দেখি?”
আমরা কোনো কথা বললাম না। জামশেদ বলল, “ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করছি না কারণ বের হয়েই যদি ইন্দুরের বাচ্চার মত প্যানপ্যানানী শুরু কর? কোনো ফাজিল সাংবাদিকেরা যদি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে ফেলে? সেই ছাগল সাংবাদিক যদি তোমাদের কথা বিশ্বাস করে রিপোর্ট করে ফেলে তখন একটা কাজ বাড়বে। রিপোর্টারকে ফিনিস করতে হবে। সেইটা অবশ্যি সমস্যা না, আমি মাসে দুই চারটা সাংবাদিক জুতো দিয়ে পিশে ফেলি।” কথা শেষ করে মানুষটা চেয়ারে তার পা দিয়ে পিষে ফেলার অভিনয় করে দেখাল।
মেজর জামশেদ নামে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার শরীরটা কেমন যেন শির শির করতে থাকে। সর্বনাশ! কি ভয়ংকর মানুষ।
জামশেদ একটু দম নিল তারপর বলল, “কাজেই আমাকে একটা জিনিষ নিশ্চিত করতে হবে, সেটা হচ্ছে তোমরা এখান থেকে বের হয়ে যেন আলতু ফালতু কথা না বল। বুঝেছ? আমার কথা বুঝেছ?”
তার কথা বুঝতে আমাদের কোনো সমস্যা হল না। কিন্তু আমরা কোনো কথা বললাম না, চুপ করে রইলাম। জামশেদ আরেকটা কী কথা বলার জন্যে তার চকচকে সোনার দাঁত বের করে মুখ হা করল ঠিক তখন তার টেলিফোন বাজল। সে টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে গেল। টেলিফোনটা ধরে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গিয়ে হড়বড় করে বলল, “ইয়েস স্যার। মালিকুম স্যার।”
টেলিফোনের অন্য পাশ দিয়ে কে কী বলছে আমরা শুনতে পেলাম না কিন্তু মনে হল মানুষটা অনেক বড় অফিসার আর সেই বড় অফিসার জামশেদকে একটা ধমক দিল। জামশেদ আরো কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে স্যার। ছেলেমেয়েগুলোকে রিকভার করে ভেহিকেলটা নিয়ে ফিরে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেছে স্যার। আই অ্যাম সরি স্যার আমার আরো আগে রিপোর্ট করা উচিৎ ছিল স্যার। আর ভুল হবে না স্যার।”
মনে হল বড় অফিসারটা বলল যে সে আমাদের দেখতে আসবে সেটা শুনে জামসেদ খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, “না না না স্যার। আপনার আসার কোনো দরকার নাই স্যার। কোনো দরকার নাই স্যার। দে আর লাইক স্ট্রীট আরফিন। স্যার, মহব্বতজান স্কুলের ছাত্র তাই বুঝতেই পারছেন চাল চুলো নেই কিছু বদ ছেলে মেয়ে স্যার। নো ডিসিপ্লিন ইন লাইফ স্যার। স্যার, ওদের দেখলে আপনার মন খারাপ হবে স্যার।”