বেশ কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টারটা চলে গেল তখন আমরা খুব সাবধানে মেঘ থেকে বের হয়ে এলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে আমরা তখন আমাদের স্কুলে ফিরে যেতে থাকি।
প্রথম দিন আমি আর মিঠুন যেভাবে হারিয়ে গিয়েছিলাম আজকেও আমাদের সেই একই অবস্থা হল, আমরা আবার হারিয়ে গেলাম। তবে আজকে আমাদের অবস্থা প্রথম দিনের মত তত খারাপ হল না। প্রথমত আজকে এখনো দিনের আলো আছে, নিচে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত আজকে ছয়জন মানুষ থাকায় কোনদিকে যেতে হবে সেটা সবাই মিলে বের করে ফেলা যাচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত যখন স্কুলটা পাওয়া গেল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে সাংবাদিকদের ফ্লাইং মেশিনটা দেখার ঠিক করে আমরা স্কুলের ছাদে নেমে এলাম।
ঠিক যখন ফ্লাইং মেশিনটা ছাদে নেমেছে, মিঠুন সুইচ অফ করে ইঞ্জিনটা বন্ধ করেছে তখন হঠাৎ চারপাশ থেকে কালো পোষাক পরা ডজন খানেক মানুষ হাতে ভয়ংকর ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তারা আমাদের মুখ চেপে ধরে রাখল যেন আমরা চিৎকার করতে না পারি। আমাদেরকে টেনে হেঁচড়ে তারা নিচে নিয়ে বড় একটা গাড়িতে ঢুকিয়ে দেয়। কিছু বোঝার আগে ভিতরের মানুষগুলো আমাদের হাত পা বেঁধে মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়।।
আমরা হুটোপুটি করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলাম, খুব একটা লাভ হল না। অবাক হয়ে দেখলাম উজন খানেক মানুষ আমাদের ফ্লাইং মেশিনটা ধরাধরি করে নামাচ্ছে। আমাদের গাড়ির পিছনে আরেকটা মিলিটারী ট্রাক, ফ্লাইং মেশিনটাকে সেখানে তুলে ফেলা হল। তারপর আমাদের গাড়িটি আর পিছু পিছু ট্রাকটা চলতে শুরু করে, আমাদের কোথায় নিচ্ছে আমরা সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুব একটা লাভ হল না কারণ গাড়ি চলতে শুরু করতেই তারা আমাদের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল।
আমি বুঝতে পারলাম আমরা ভয়ংকর একটা বিপদের মাঝে পড়েছি।
১০. আমাদেরকে যেখানে আটকে রেখেছে
আমাদেরকে যেখানে আটকে রেখেছে সেটা মনে হয় বড় একটা বাসার উপরের তালার একটা রুম। রুমটায় ঢুকিয়ে মানুষগুলো আমাদের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছে তখন আমরা নিজেরাই চোখের বাধন খুলেছি, মুখের উপর লাগানো টেপটা খুলেছি। আমরা এখন একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছি, একজনের সাথে আরেকজন কথা বলতে পারছি। প্রথম কথা বলল ঝুম্পা, “আমি যদি এই হারামজাদাদের ভূঁড়ি ফাঁসিয়ে না দেই তাহলে আমার নাম ঝুম্পা না।”
ফারা একটু অবাক হয়ে বলল, “তুই কেমন করে ভূঁড়ি ফাঁসাবি?”
ঝুম্পা বলল, “জানি না।”
আমি বললাম, “এরা অনেক ক্ষমতাবান। আমাদের কীভাবে ধরে এনেছে দেখেছিস?”
বগা জানতে চাইল, “কেন ধরে এনেছে?”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “সেটা এখনো বুঝতে পারছিস না গাধা কোথাকার? ওরা ধরে এনেছে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার জন্য।”
“কী করবে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা দিয়ে?”
“কী করবে মানে? তুই দেখছিস না ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা দিয়ে কী করা যায়? আমরা আকাশ থেকে উড়ে এসেছি ছোট বিন্দি একটা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা দিয়ে আর তুই জিজ্ঞেস করছিস কী করা যায়?”
মিঠুন কোনো কথা না বলে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখল। একটা টেবিল একটা চেয়ার একপাশে একটা খাট, খাটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানা। সাথে একটা ছোট হাইফাই বাথরুম। একটা জানালা বাসার ভেতরের দিকে আরেকটা জানালা বাইরের দিকে। সেদিকে তাকালে দেখা যায় দূরে উঁচু একটা বাউন্ডারী ওয়াল। বাউন্ডারী ওয়ালের অন্যপাশে কী আছে আমরা জানি না।
মিঠুনকে কেমন জানি মনমরা দেখাল, এদিক সেদিক দেখে বলল, “শুধু শুধু আমার জন্যে তোদের কতো রকম যন্ত্রণা। আমি মানুষটাই অপয়া। যেখানে হাত দেই সেখানেই সর্বনাশ হয়ে যায়।”
ফারা বলল, “তুই অপয়া হবি কেন? তোর কী দোষ? তুই হচ্ছিস আমাদের সায়েন্টিস্ট।”
মিঠুন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এখন আমাদের কী করবে কে জানে! যদি মেরে ফেলে?”
ঝুম্পা বলল, “মেরে ফেলবে? ফাজলেমী নাকী?”
মিঠুন, “আমাদের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা আসলে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বেশী।”
মন খারাপ মনে হয় ছোঁয়াচে, মিনি মন খারাপ করে কথা বলা মাত্র আমার সবারই কম বেশী মন খারাপ হয়ে গেল। ঝুম্পা বলল, “আমাদের মেরে ফেলুক আর না ফেলুক আমার জীবন শেষ।”
ফারা জিজ্ঞেস করল, “কেন তোর জীবন শেষ কেন?”
“কতো রাত হয়েছে এখনো বাসায় যাই নাই, মামা মামী কী আমাকে বাসায় ঢুকতে দিবে? দিবে না। বাসা থেকে বের করে দিবে।”
আমি বললাম, “সেইটা নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে, আগে দেখ এখন কী হয়।”
বগা বলল, “খিদে লেগেছে।”
আমরা সবাই অবাক হয়ে বগার দিকে তাকালাম, আমি গরম হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এরকম সময় তোর খিদে পেয়ে গেল?”
“খিদে পেলে আমি কি করব?”
“চুপ করে বসে থাকবি।”
ফারা বলল, “ব্যাস অনেক হয়েছে, এখন আর নিজেদের মাঝে ঝগড়া করিস না।”
আমরা তখন দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে রইলাম। কী হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। এর চাইতে কষ্টের কিছু আছে কী না কে জানে।
ঘণ্টা খানেক পরে বাইরে পায়ের শব্দ পেলাম, দরজায় একটা শব্দ হল তারপর খুট করে দরজা খুলে গেল। দরজার বাইরে কালো পোষাক পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার উঁচু চোয়াল সরু ঠোঁট। নাকের নিচে নবাব সিরাজদৌল্লার মত চিকন গোঁফ।।
মানুষটা দরজাটা বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টির মাঝে কিছু একটা আছে যেটা দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়, ভয় করে।