বিশাল একটা হুটোপুটি লেগে যায়। মানুষগুলো চিৎকার করে বলল, “আমরা ছেলেধরা না–আমরা ইন্টেলিজেন্স এর লোক।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা আমরা হুটোপুটির মাঝে বের হয়ে দে দৌড়।
এর পরের কয়েকদিন আমরা টের পেলাম আমাদের নিয়ে বিশেষ করে মিঠুনকে নিয়ে কিছু একটা ঘটছে। যখনই আমরা বের হই তখনই মনে হয় আমাদের পিছু পিছু কেউ হাঁটছে। হঠাৎ করে গাড়ি পাশে দাঁড়িয়ে যায়আমরা তখন ছুটে পালাই, গাড়ীর ভেতর থেকে ঘঁাচ ঘঁাচ করে ছবি তুলে নেয়। ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার জন্যেই এসব ঘটছে, কাজেই আমাদের প্রথম কাজ হল সেটাকে ভালো করে লুকিয়ে রাখা। ফ্লাইং মেশিনের ভেতর থেকে আসল ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা সরিয়ে আমরা সেখানে ফাঁকা একটা শিশি রেখে দিলাম। আসলটা লুকিয়ে রাখলাম ল্যাবরেটরির কংকালটার খুলির ভিতরে।
মিঠুন খুব খাটাখাটুনি করে শেষ পর্যন্ত ফ্লাইং মেশিনটাকে দাড়া করাল। দুজনের জায়গায় এখন ছয়জন যেতে পারবে। সেজন্যে ইঞ্জিনটার পরিবর্তন করল, পাখাগুলো পরিবর্তন করল, পিছনে প্লেনের লেজের মত একটা লেজ লাগালো। তারপর একদিন আমাদের বলল, “আমি রেডি। আমরা এখন ছয়জন যেতে পারব।”
স্কুল ছুটির পর আমরা রয়ে গেলাম। স্কুলের স্যার, ম্যাডামরা ছুটির আগেই চলে যায়, ছাত্র-ছাত্রীরা যায় একটু পরে। তারা চলে যাবার পর পুরো স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল। তখন আমি, মিঠুন, ঝুম্পা বগা আর যারা দোতালায় উঠে গেলাম। মিঠুনের ফ্লাইং মেশিনটা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলাম, মিঠুন পুরোটা ভাল করে দেখল, এখানে সেখানে ধাক্কা দিল, টানাটানি করল, আঁকুনি দিল, টেপাটেপি করল। তারপর কংকালের করোটির ভেতর থেকে ব্লাকহোলের বাচ্চা ভরা শিশিটা নিয়ে ফ্লাইং মেশিনে লাগিয়ে দিল।
তারপর আমরা ফ্লাইং মেশিনে উঠলাম, দুইটি করে সিট, প্রথমে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে মিঠুনের পাশে আমি বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঝুম্পা জোর করে আমার জায়গায় বসে গেল। মাঝখানে বসল বগা আর ফারা। পিছনে আমি একা।
মিঠুন বলল, “সবাই সিট বেল্ট বেঁধে নে।”
আমার সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।
“তোরা কেউ ভয় পাবি না–এটা কাপতে পারে, দুলতে পারে উপর নিচ করতে পারে কিন্তু কখনোই নিচে পড়ে যাবে না।”
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম “ঠিক আছে।”
“সিট থেকে বেশি নাড়াচাড়া করবি না–সেন্টার অফ গ্রাভিটি অনেক গবেষণা করে ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে–নাড়াচাড়া করলে সেটার উনিশ বিশ হতে পারে–তখন ফ্লাইটেরও উনিশ বিশ হতে পারে।”
মিঠুনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বুঝতে পারলাম না–সিটে বেশি নাড়াচাড়া করার বিষয়টা খালি বুঝতে পারলাম। সেটার জন্যই জোরে জোরে মাথা নাড়লাম।
“তাহলে শুরু করছি” বলে মিঠুন কন্ট্রোল প্যানেলের একটা সুইচ টিপে ধরল, সাথে সাথে ফ্লাইং মেশিন থরথর করে কাঁপতে থাকে। ফারা ভয় পেয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?”
মিঠুন বলল, “ভয়ের কিছু নাই। চুপ করে বসে থাক।”
“ভেঙ্গে পড়ে যাবে না তো?”
“না ভাঙবে না। সবাই শক্ত হয়ে বসে থাক আমরা টেক অফ করছি।”
মিঠুন একটা হ্যান্ডেল নিজের দিকে টেলে নিল। সাথে সাথে ফ্লাইং মেশিনের নিচ দিয়ে আগুনের একটা হালকা বের হতে থাকে আর ফ্লাইং মেশিনটা পিছনের দিকে কাত হয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। আমরা সবাই একই সাথে ভয় আর আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। দেখতে দেখতে ফ্লাইং মেশিনটা স্কুলের ছাদ পার হয়ে গাছগুলো পার হয়ে উপরে উঠে যায়।
আমরা সবাই আবার ভয় আর আনন্দের শব্দ করে উঠলাম। মিঠুন আরেকটা হ্যান্ডেল টেনে ধরতেই ফ্লাইং মেশিনটা কাত হয়ে ঘুরে যেতে শুরু করে, আমাদের মুখে বাতাসের ঝাপটা লাগতে থাকে আর ফ্লাইং মেশিনটা ঘুরে যেতে শুরু করে। আমরা নিচের দিকে তাকালাম, স্কুলটাকে ঠিক চেনা যায় না দোকান পাট, রাস্তা, রাস্তায় গাড়ী ট্রাক টেম্পাে সবকিছুকে কেমন যেন খেলনার মত মনে হতে থাকে।
মিঠুন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে?”
ঝুম্পা বলল, “ফাটাফাটি।”
ফারা জিজ্ঞেস করল, “পড়ে যাব না তো?”
“না, পড়বি না।”
ঝুম্পা বলল, “আরো উপরে নিয়ে যা–অনেক উপরে।”
বগা ভয়ে ভয়ে বলল, “কোনো সমস্যা হবে না তো?”
ঝুম্পা বলল, “হলে হবে। নিয়ে যা উপরে।”
মিঠুন তখন ফ্লাইং মেশিনটাকে আরো উপরে নিয়ে যায় সেখান থেকে নিচের পৃথিবীটাকে কেমন যেন অবাস্তব মনে হতে থাকে।
মিঠুন ফ্লাইং মেশিনটাকে ওপরে এক জায়গায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে পার্ক করলাম।”
বগা বলল, “পার্ক করলি?”
“হ্যাঁ। এখানে চুপচাপ ভেসে থাকব।”
আমি বললাম, “মোটেও চুপচাপ ভেসে নাই। তোর ইঞ্জিনটা শো শো করে শব্দ করছে।”
মিঠুন বলল, “আমি ইচ্ছে করলে ইঞ্জিনটা বন্ধ করে শব্দও বন্ধ করে দিতে পারি। তবে”।
“তবে কী?
“তাহলে এই ফ্লাইং মেশিন মারবেলের মতন টুপ করে নিচে পড়ে যাবে।”
ঝুম্পা হি হি করে হাসল বলল, “থাক বাবা তোর ইঞ্জিন বন্ধ করার কোনো দরকার নাই। আমি এর মাঝে বসে বসেই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারব।”
আমরা সবাই তখন চারিদিকে তাকালাম, বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমরা অনেকদূর সরে এসেছি। নিচে একটা সরু নদী দেখা যাচ্ছে, রোদ পড়ে সেটা চিক চিক করছে। নদীটার ওপার একটা নৌকা— কী আশ্চর্য সেই দৃশ্য। নদীর দুই তীরে সবুজ ধানক্ষেত, ধানক্ষেত যে এতো সবুজ হতে পারে আমি আগে কখনো দেখিনি।
মিঠুন বলল, “আমার মনে হয় এখন আমরা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার কথা সবাইকে বলে দিই।”