চা খেতে খেতে মিঠুন বলল, “আমাদের এই ফ্লাইং মেশিনের সুবিধে কী জানিস?”
“কী সুবিধা?”
“এইখানে যে ফুয়েল আছে সেটা কোনোদিন শেষ হবে না”। “শেষ হবে না?”
“না। এনার্জীটা খরচ হয় ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার দিয়ে। তার মানে শক্তি প্রায় অফুরন্ত। তাছাড়া—”
“তাছাড়া কী?”
“যখন এনার্জী ব্যবহার করি না তখন আমার ধারণা ব্লাকহোলের বাচ্চা চারপাশের ভর শুষে বড় হতে থাকে। এটা যেহেতু অন্যরকম ভর তাই আমরা টের পাই না। তবে—”
“তবে কী?”
মিঠুন উত্তর না দিয়ে হঠাৎ করে মুখ সুঁচালো করে কিছু একটা ভাবতে লাগল। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা অবাস্তব স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে। গভীর রাতে আমি আর মিঠুন আকাশে ঝুলে ঝুলে চা খাচ্ছি। শুধু তাই না মিঠুন চা খেতে খেতে বৈজ্ঞানিক চিন্তার মাঝে ডুবে আছে। সত্যি কথা বলতে কী প্রথম প্রথম আমার যেরকম অসম্ভব ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল এক্ষুণি বুঝি ধপাস করে আকাশ থেকে পড়ে যাব এখন আর সেরকম মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আকাশে ঝুলে থাকা এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার না।
আমি চা শেষ করে বললাম, “মিঠুন এখন নিচে চল।”
“হ্যাঁ” মিঠুন বলল, “একটু একটু ঠাণ্ডা লাগছে।”
মিঠুন তার কপালে লাগানো লাইটটা জ্বালিয়ে প্যানেলটা দেখে একটা সুইচ টিপে আরেকটা হ্যান্ডেল ধরে নিজের দিকে টেনে আনে। ফ্লাইং মেশিনটা একটা ঝাঁকুনী দিয়ে নিচে নামতে থাকে। আমি নিচের দিকে তাকালাম, সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “স্কুলটা কোন দিকে?”
“কী জানি?”
“কী জানি মানে?”
আমি রেগে উঠে বললাম, “না জানলে যাবি কেমন করে?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না!” মিঠুন বলল, “যখন সামনে পিছে ডানে বায়ে গেছি তখন অনেক দূরে সরে গেছি। তাছাড়া
“তাছাড়া কী?”
“বাতাসেও মনে হয় সরে এসেছি।”
“এখন?”
মিঠুন মাথা চুলকালো, “স্কুলটা খুঁজে বের করতে হবে।“
“কেমন করে খুঁজে বের করবি?”
মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না আমি এর আগে কখনো আকাশে হারিয়ে যাইনি।”
সেটা সত্যি কথা। নিচে হারিয়ে গেলেও রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে কোথাও না কোথাও পৌঁছানো যায়। আকাশে কোনো রাস্তা নেই—আকাশে হারিয়ে গেলে কোনদিকে যেতে হবে বোঝার কোনো উপায় নেই।
অনেক কষ্ট করে যখন শেষ পর্যন্ত স্কুলটা খুঁজে পেলাম তখন ভোররাত হয়ে গেছে। ফ্লাইং মেশিনটা নিচে নামিয়ে মিঠুন বলল, “এতো রাতে বাসায় গিয়ে কী হবে? আর স্কুলে ঘুমিয়ে যাই।”
আমি বললাম, “তোর বাসায় চিন্তা করবে না?”
“নাহ!” মিঠুন বলল, বাসায় বলেছি আজ রাতে তোর বাসায় থেকে রাত জেগে সমাজ পাঠ পড়ব।”
“সমাজ পাঠ?”
“হ্যাঁ।” মিঠুন তার ফ্লাইং মেশিনের যন্ত্রপাতিগুলো টানাটানি করে কী যেন দেখল তারপর মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির মত শব্দ করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর বাসায় চিন্তা করবে না?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। আমার বাসায় আব্দু ছাড়া আর কেউ নাই। আব্ব আমাকে নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না। কয়েক রাত বাতে না গেলেও আব্ব বুঝতেই পারবে না।”
মিঠুন বলল, “তোর কী মজা!”
আমি ছোট একটা নিশ্বাস ফেললাম। সত্যিই কী আমার অনেক মজা।
মিঠুন ল্যাবরেটরি ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলে উঠে বলল, “উড়তে পারলাম কী না?”
“পেরেছিস। তুই একটা জিনিয়াস।”
“সত্যি? তোর তাই মনে হয়?”
“হ্যাঁ। সুপার জিনিয়াস।”
মিঠুন বাচ্চা ছেলের মত খুশী হয়ে উঠল, “শুধু তুই ভালো ভাবে দেখেছিস। সবাই শুধু বকাবকি করে।”
“এই ফ্লাইং মেশিন দেখলে বাককি করবে না। যেই দেখবে সেই ট্যারা হয়ে যাবে কেনো সন্দেহ নাই।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। প্রথমবার উঠার সময় একটু ভয় পেতে পারে কিন্তু একটু অভ্যাস হয়ে গেলে ট্যারা হয়ে যাবে। কোনো সন্দেহ নাই।”
মিঠুন টেবিলটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি আরেকটা টেবিলে শুয়ে পড়লাম। সারারাত ঘটনাগুলো মাথার মাঝে খেলা করছিল। মনে হচ্ছিল বুঝি ঘুমই আসবে না, কিন্তু এক সময় সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম।
০৯. পরের দিন খুব উত্তেজনার মাঝে গেল
পরের দিন খুব উত্তেজনার মাঝে গেল। আমি যখন ঝুম্পা ফারা আর বগাকে ফ্লাইং মেশিনের কথা বললাম, তারা প্রথমে আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইল না। তাদের ল্যাবরেটরি ঘরে ফ্লাইং মেশিনটা দেখানো হল তারপরও তারা বিশ্বাস করতে চাইল না। অনেক রকম কীরা কসম কাটার পর শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করল, তখন সবাই এক সাথে ফ্লাইং মেশিনে উঠতে চাইল।
মিঠুন, বলল “একসাথে তো সবাই উঠতে পারবে না। একজন একজন করে উঠতে হবে।”
ঝুম্পা বলল, “ঠিক আছে, একজন একজন করেই উঠি। আগে আমাকে ওঠা।”
মিঠুন মাথা চুলকে বলল, “দিনের বেলা ওঠা তো ঠিক হবে না। সবাই দেখে ফেলবে।”
ঝুম্পা বলল, “দেখে ফেললে সমস্যা কী?”
মিঠুন বলল, “এখনই জানাজানি হলে সমস্যা আছে। প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মারা যাব।”
ঝুম্পা বলল, “ঠিক আছে তাহলে রাত্রি বেলাই চলে আসব।”
মিঠুন বলল, “তুই আসবি ঠিক আছে কিন্তু আমাকে বাসা থেকে রাত্রি বেলা বের হতে দিচ্ছে না।”
“কেন?”
“সেদিন যে ইবুর সাথে রাতে গেলাম তখন আম্মু সন্দেহ করেছে। এখন কয়দিন বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছে না।”
আমি বললাম, “রাত্রি বেলা চোরের মত ফ্লাইং মেশিনে উড়ে কোনো মজা নাই। দিনের বেলা উড়তে হবে।”
মিঠুন খানিকক্ষণ চিন্তা করল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস। আমারা কী চুরি করেছি নাকি যে চোরের মত থাকতে হবে?”