“থিওরিটিক্যালী জানি। প্র্যাকটিক্যালী যা খুশী হতে পারে।”
আমি আমার সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বললাম, “ মিঠুন, তুই যাআমি যাব না।”
কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। মিঠুন সামনের প্যানেলে কী একটা সুইচ অন করে দিল—আর সাথে সাথে মিঠুনের ফ্লাইং মেশিনটা থরথর করে কাপতে লাগল। মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “আরে, কাপছে কেন?”
আমিও ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে? কাঁপছে কেন?”
মিঠুন আমার কথায় উত্তর দিল না, প্যানেলের কী একটা হ্যান্ডেল ধরে টান দিল—তখন কাপুঁনীটা আরো বেড়ে গেল, আমি ভোঁতা একটা শব্দ শুনলাম আর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফ্লাইং মেশিনের নিচে দিয়ে আগুনের মত কী একটা বের হতে শুরু করেছে। আমি আমার পায়ে গরম বাতাসের একটা হলকা অনুভব করলাম। ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে মিঠুন? কী হয়েছে?”
মিঠুন আমার কথার উত্তর দিল না, বিড়বিড় করে বলল, “ওয়েট ব্যালেন্স হয় নাই।”
আমি চিৎকার করে বললাম, “সেইটার মানে কী? “টেক অফের সময় সমস্যা হতে পারে। শক্ত করে ধরে রাখিস?”
“কী শক্ত করে ধরে রাখব?”
মিঠুন হ্যান্ডেলটা আরো জোরে টেনে ধরল আর ঠিক তখন ফ্লাইং মেশিনটা পিছন দিকে কাৎ হয়ে গেল, আমি চিৎকার করে ভয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফ্লাইং মেশিনটা পিছন দিকে আরো কাত হয়ে আরো জোরে থর থর করে কাপছে-মনে হচ্ছে এক্ষুনি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ভয়ে আতংকে আমি চিৎকার করে বললাম, “নামব, আমি নামব। এইখানে থাকব না। তোর ফ্লাইং মেশিনের খেতা পুড়ি।”
আমি সিট বেল্ট খুলে নেমে যাচ্ছিলাম, মিঠুন তখন চিৎকার করে বলল, “খরবদার!” তারপর হাত দিয়ে আমকে খপ করে ধরে ফেলল আর পুরো ফ্লাইং মেশিনটা তখন ডান দিকে কাত হয়ে গেল।
আমি চোখ খুলে তাকালাম আর হঠাৎ আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, ভয়ে আতংকে আমি জমে গেলাম। ফ্লাইং মেশিনটা আসলে ছাদের উপর নেই, কাঁপতে কাঁপতে সেটা উপরে উঠে যাচ্ছে, এর মাঝে আমরা কয়েকশ ফুট উপরে উঠে গেছি, নিচে স্কুল বিল্ডিংটাকে এখন একটা পোড়ো বাড়ীর মত মনে হচ্ছে।
মিঠুন বলল, “সীট বেল্ট বেঁধে ফেল।”
আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম, “খোদার কসম লাগে। নিচে নামা।
মিঠুন বলল, “সীট বেল্ট বাঁধ।”
আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম “নামা মিঠুন! তাড়াতাড়ি নামা।”
মিঠুন ধমক দিয়ে বলল, “সিট বেল্ট বাঁধ তা না হলে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দেব।”
মিঠুন সত্যি সত্যি লাথি দিয়ে ফেলে দেবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা না কিন্তু আমি তখন বাধ্য হয়ে কাঁপা হাতে সিট বেল্ট বাঁধলাম। মিঠুন হ্যান্ডেলটা নাড়াচাড়া করতে থাকে আর ফ্লাইং মেশিনটার কাপুনী কখননা বাড়তে থাকে কখনো কমতে থাকে। আমি ভয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম, ফ্লাইং মেশিনের নিচে দিয়ে আগুনের শিখার মতো কিছু একটা বের হচ্ছে আর আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠছি। নিচে দোকানপাট, রাস্তা, গাড়ী, ট্রাক, টেম্পাে সবকিছু ছোট হয়ে আসছে। আমার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে আছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি ফ্লাইং মেশিন নিয়ে আমরা হুড়মুড় করে নিচে আছাড় খেয়ে পড়ে একেবারে ছাতু হয়ে যাব।
কিন্তু আমরা হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম না, আকাশে ঝুলে থাকলাম। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “এই মিঠুন! আর কতো উপরে যাবি? এখন থামা।”
“ঠিক আছে এখন উপরে উঠা বন্ধ করে দিই।”
“হ্যাঁ। শুধু বন্ধ করিস না, নিচে নেমে যা।”
মিঠুন বলল, “আগেই নিচে নামব কেন? সামনে পিছনে যাব না?”
“সামনে পিছে যাবি?”
“হ্যাঁ।” বলে মিঠুন আরেকটা হ্যান্ডেল ধরে টান দেয়। সাথে সাথে পুরো ফ্লাইং মেশিনটা একটা আঁকুনী দিয়ে সামনে যেতে থাকে। আমি মুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা টের পেলাম, ভয়ে ভয়ে বললাম, “কতো জোরে যাচ্ছি?”
“ঘণ্টায় ষাট সত্তুর কিলোমিটার হবে।”
“এতো জোরে যাওয়ার দরকার আছে?”
মিঠুন আমার কথার উত্তর না দিয়ে হ্যান্ডেলটা সামনে ঠেলে দিল, সাথে সাথে ফ্লাইং মেশিনটা ঝাকুনী দিয়ে কাত হয়ে যায়, আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। মিঠুন বলল, “ভয় পাস নে এখন এটাকে ঘোরাচ্ছি।”
“আর ঘুরাতে হবে না। এখন নিচে নামা।”
মিঠুন বলল, “নামাব। আগে ভালো করে টেস্ট করে নেই।”
“আকাশে ঝুলে থেকে টেস্ট করানোর দরকার আছে? নিচে নেমে টেস্ট করা যায় না?”
মিঠুন বলল, “আকাশে সামনে পিছে ডানে বায়ে উপরের নিচে সবদিকে ফাঁকা-নিচে এই রকম ফাঁকা জায়গা পাবি?”
আমি দুর্বলভাবে বললাম, “প্রথম দিনেই সব টেস্ট করে ফেলতে হবে? কাল পরশুর জন্যে কিছু রাখবি না?”
“কাল পরশুরটা কাল পরশু দেখা যাবে। আজকেরটা আজকে। মিঠুন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, চাঁদের আলোতে তার হাসিটা অবশ্যি খুব ভালো দেখা গেল না। মিঠুন এবারে তার ব্যাগটা খুলে ভিতর থেকে ফ্লাক্সটা বের করে বলল, “আয় চা খাই।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “চা? তুই এখন চা খাবি?”
“হ্যাঁ। উপরে একটু শীতশীত করছে। চা খেলে শরীর গরম হবে। ফ্লাইং মেশিনটা পার্ক করে রেখেছি, এখন একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।”
আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না—যখন দেখলাম সত্যি সত্যি মিঠুন ফ্লাক্স থেকে একটা প্লাস্টিকের কাপে চা ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি কাঁপা হাতে কাপটা নিলাম মিঠুন তখন তার নিজের জন্যে এক কাপ ঢেলে নিয়ে খুব তৃপ্তি করে চায়ের কাপে চুমুক দিল। কেউ যদি একদিন আগেও আমাকে বলত যে পরের দিন আমি আকাশে ঝুলে থেকে চা খাব আমি কী সেটা বিশ্বাস করতাম?