এর ঠিক দুইদিন পর ইংরেজি ক্লাশে মিঠুন আমার কাছে গলা নামিয়ে বলল, “ইবু। আজ সন্ধেবেলা তুই স্কুলে আসতে পারবি?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম “কেন?”
“আজকে আমি একটা জিনিষ পরীক্ষা করব।”
“কী পরীক্ষা করবি?”
“ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা দিয়ে যেটা বানিয়েছি”
“কী বানিয়েছিস?”
“তুই আসলেই দেখবি। এখন আর কাউকে কিছু বলছি না শুধু তুই আর আমি।”
মিঠুন যখন শুধু আমাকে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলছে না তখন আমাকে তো আসতেই হয় তাই সন্ধেবেলা আমি চলে এলাম। আসার সময় দেখলাম বাবা অস্ট্রেলিয়ার সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখছে, আমি যখন বললাম, “বাবা একটা কাজে যাচ্ছি আসতে দেরী হতে পারে।”
বাবা সেটা শোনার চেষ্টাও করল না, হাত নেড়ে আমাকে বিদায় করে দিল। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি ফিরতে কেন দেরী হবে কিছুই জানতে চাইল না।
স্কুলে গিয়ে দেখি মিঠুন এর মাঝে চলে এসেছে। স্কুলের বারান্দায় বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, “এসেছিস?”
“আয়।”
“কোথায়?
মিঠুন কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ল্যাবরেটরি ঘরে চাবি খুলে ঢুকল। বলল, “যে যন্ত্রটা বানিয়েছি সেটা আজকে জোড়া লাগা, আলাদা আলাদাভাবে তৈরী হয়েছে আজকে একত্র করা হবে।”
মিঠুন তখন পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভঁজ খুলে মেঝেতে রাখল–বলল, “এইটা হচ্ছে ডিজাইন।
আমি ডিজাইনের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিঠুন বলল, “আয় কাজ শুরু করি।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
মিঠুন তখন কাজ শুরু করল। দুইটা ভাঙ্গা চেয়ার পেরেক দিয়ে ঠুকে জুড়ে দিল। চেয়ারের পাগুলো করাত দিয়ে কেটে সেখানে নানারকম যন্ত্রপাতি লাগাতে লাগল। ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে বড় বড় স্কু লাগাতে লাগল। অনেকগুলো টিউব বাঁকা করে লাগিয়ে দিল। মাঝখানে স্টীলের তৈরী ভারী একটা সিলিন্ডার লাগালো। সেখান থেকে অনেকগুলো তার বের হয়েছে সেই তারগুলো একটা প্যানেলের মাঝে লাগালো। প্যানেলটা চেয়ার দুটোর সামনে একটা কাঠের টুকরো দিয়ে লাগিয়ে নিল। চেয়ার দুটোর চারপাশে হার্ডবোর্ডের কয়েকটা পাখা লাগাল। দেখতে দেখতে পুরো জিনিষটা একটা জটিল যন্ত্রের মত দেখাতে থাকে, মনে হতে থাকে এটা বুঝি!
কোনো সায়েন্স ফিকশানের সিনেমা থেকে বের হয়ে এসেছে।
রাত দশটার দিকে আমি মিঠুনকে বললাম, “খিদে পেয়েছে।” মিঠুন বলল, “ঠিক বলেছিস। আয় খাই।”
“কী খাবি?”
“বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছি।” বলে মিঠুন তার ব্যাগ থেকে নানা রকম খাবারের বাক্স বের করতে থাকে। পরটা, কাবাব, মিষ্টি, আপেল, দই এবং ফ্লাক্সে গরম চা। এতো খাবার যে আমরা দুজনে মিলে খেয়ে শেষ করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “তুই প্রত্যেকদিন এভাবে খাস? তাহলে তো হাতীর মত মোটা হয়ে যাবি।”
মিঠুন বলল, “না। প্রত্যেক দিন খাই না। আজকে বিশেষ দিন সেইজন্যে খাচ্ছি।”
“আজকে বিশেষ দিন কেন?”
“আজকে এই স্পেশাল ফ্লাইং মেশিনটা উড়াব সেই জন্যে স্পেশাল খাবার।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “ফ্লাইং মেশিন? এটা ফ্লাইং মেশিন? এটা উড়বে?”
“হ্যাঁ।”
“ঘরের ভেতর কেমন করে উড়বে?”
“ঘরের ভেতর উড়বে না গাধা। আমরা এখন এটা বাইরে নিয়ে যাব।”
তখন মিঠুন আর আমি ধরাধরি করে এই জটিল যন্ত্রটা ঘরের বাইরে নিয়ে গেলাম। দোতলাটা পুরো শেষ হয়নি। বিশাল অংশ খোলা ছাদ। বিল্ডিংয়ের চারপাশে বড় বড় গাছ সেই ছাদটাকে ঘিরে রেখেছে তাই বাইরে থেকে এই জায়গাটা দেখা যায় না।
মিঠুন তার ফ্লাইং মেশিনটাকে ছাদের মাঝখানে রাখল। আবছা অন্ধকারে এটাকে কেমন যেন রহস্যময় দেখাতে থাকে। মিঠুন তখন তার ব্যাগ থেকে একটা লাইট বের করে তার কপালে বেঁধে ফেলল। সেখানে একটা সুইচ টিপে দিতেই আলোটা জ্বলে উঠে এবং মিঠুনকে তখন একজন মহাকাশচারীর মত দেখাতে থাকে।
মিঠুন আরেকটা লাইট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “নে এটা তোর মাথায় বেঁধে নে। অন্ধকারে প্যানেলটা দেখতে পাবি।”
অন্ধকারে প্যানেলটা আমার কেন দেখতে হবে আমি সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না, মিঠুনের কথা মত মাথায় বেঁধে নিলাম। মিঠুন বলল, “আয় উঠি।”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আগে একটু পরীক্ষা করে দেখলে হয় না এটা ঠিকমত কাজ করে কী না?”
“সেটাই তো করতে যাচ্ছি।”
“তাহলে উঠতে হবে কেন? না উঠে পরীক্ষা করা যায় না?”
“আর যখন এটা উড়ে চলে যাবে তখন কী করে নামাব?”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “ইয়ে, মানে—”
মিঠুন বলল, “ও! তুই ভয় পাচ্ছিস? ভয় পেলে থাক, উঠতে হবে না।”
ভীতু বলে অপবাদ দেয়ার পর তো আর পেছানো যায় না। বললাম, “ভয় পাব কেন? ভয় পাবার কী আছে?”
তারপর মিঠুনের ফ্লাইং মেশিনে উঠে বসলাম। মিঠুনও অন্যদিক দিয়ে উঠে বসে। ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে সেখান থেকে দুটো বেল্ট বের করে আনে। একটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “বেঁধে নে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম “কী বেঁধে নেব?”
“নিজেকে চেয়ারের সাথে বেঁধে নে, সিট বেল্টের মতন।”
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম “কেন? বাঁধতে হবে কেন?”
“উপর থেকে যেন পড়ে না যাস।”
“পড়ে যাওয়ার কথা বলছিস কেন?”
“ফ্লাইং মেশিন উড়তে উড়তে যদি কাত হয়ে যায়? উল্টো হয়ে যায়?” আমি শুকনো গলায় বললাম, “কাত হবে কেন? উল্টো হবে কেন?”
“ব্লাকহোলের বাচ্চা দিয়ে যে ইঞ্জিনটা বানিয়েছি সেটা যদি কন্ট্রোল না করা যায় তখন যা খুশি তা হতে পারে।”
“যা খুশি হবে মানে? কী হবে তুই জানিস না?”