মিঠুন এক সেকেন্ডের জন্যে হকচকিয়ে গেল তারপর বলল, “ঠিক আছে, দে! বোতলটার মাঝে রেখে দে।”
আমি তখন বোতলটার মাঝে চিউয়িং গামটা রেখে দিলাম।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা মুখ কালো করে বসে থাকল। দর্শকদের ভেতর থেকে কেউ কেউ চাপা স্বরে হঠাৎ করে “হাম্বা” করে ডেকে উঠছিল সেটা শুনে তাদের মুখ আরো কালো হয়ে উঠল। হাই প্রেশার প্লাজমা প্রজেক্টটাকে যখন জুনিয়র গ্রুপের চ্যাম্পিওন ঘোষণা করা হল তখন কেউ অবাক হল না। আমরা তখন যেভাবে গর্জন করে উঠলাম সেটা এই শহরের মানুষ অনেকদিন মনে রাখবে। পুরস্কার নেওয়ার জন্যে মিঠুনের সাথে সাথে আমরাও স্টেজে উঠে গেলাম, পুরস্কারটা হাতে নেবার পর আমরা যেভাবে চেচামেচি করলাম সেটা দেখে সবাই বুঝতে পারল আমরা এর আগে জীবনেও কোনোদিন কোনো পুরস্কার পাইনি পুরস্কার পাবার পর কী করতে হয় সেটা আমাদেরকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি।
যখন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হচ্ছে তখন বিচারকদের একজন প্রফেসর দর্শক সারি থেকে উঠে গেলেন। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম সেই প্রফেসর হল ঘরের দিকে যাচ্ছেন। সেখানে কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হল না। সেদিন বিকালে হাই প্রেশার প্লাজমা যন্ত্রটা খুলে নেয়ার সময় আমরা দেখলাম সেখানে ছোট বোতলটা আছে কিন্তু তার ভেতরকার চিবিয়ে ছাতু করে রাখা চিউয়িংগামটা নাই।
আমাদের মহব্বতজান স্কুলের ইতিহাসে কখনো এসেম্বলী হয় না, কখনো জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। পরের দিন এসেম্বলী হল, এমন কী ভুল সুরে কয়েকজন জাতীয় সংগীত পর্যন্ত গেয়ে ফেলল। তারপর আমাদের হেড স্যার কাঁপা গলায় বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, “আমার ফ্রিয় ছেলে মেয়েরা (স্যার প্রিয় উচ্চারণ করতে পারেন না। তোমরা সবাই শুনছ আমাদের হাজী মহব্বতজান উচ্চ বিদ্যালয় বিজ্ঞান মেলায় চ্যাম্পিওন হইছে। আমরা চিৎকার করলাম লাফালাফি করলাম। আলহাজ মহব্বত জান স্যারের নেতৃত্বে এই ইস্কুল শুধু এই শহরের মইধ্যে না এই দেশের মইধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ইস্কুল হয়া যাইব। (কথাটা পুরাপুরি মিথ্যা কিন্তু তারপরেও আমরা আবার একটু চিৎকার করলাম।) যখন কেলাশ এইটের ছেলে মেয়েরা আমার কাছে আইসা বলল তারা সায়েন্স ফেয়ারে যোগ দিতে চায় আমি সাথে সাথে সেই অনুমতি দিছি। (কত বড় বানোয়াট কথা!) শুধু অনুমতি না, আমি তাগো রিচার্সের জন্যে (শব্দটা নিশ্চয়ই রিসার্চ কিন্তু হেড স্যার রিসার্চ বলতে পারেন না, বলেন রিচার্স দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিছি। (আমরা আবার চিৎকার করলাম কেলাশ এইটের ছেলে মেয়েরা এই দশ হাজার টাকার মর্যাদা রাখছে, তারা পুরস্কার আনছে। এই স্কুলের সুনাম অক্ষুন্ন রাখছে।…”
হেড স্যার অনেকক্ষণ ভ্যাদর ভ্যাদর করলেন। আমরা সবাই সহ্য করলাম। বক্তৃতার শেষে স্যার পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে একদিনের ছুটি ঘোষণা দিলেন।
০৮. সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর
সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর মহব্বতজান স্কুলে কয়েকটা পরিবর্তন হল। তার মাঝে একটা হল স্কুলের ল্যাবরেটরিরে একটা চাবি আমাদের পাকাপাকিভাবে দিয়ে দেয়া হল, আমরা যখন খুশী সেখানে যেতে পারি যতক্ষণ খুশী যেখানে থাকতে পারি। ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছি এরকম ভান করে আমরা এখানে বসে প্রত্যেকদিন আড্ডা মারি কেউ কিছু বলে না।
আমাদের বিজ্ঞান স্যার কালাপাহাড় মিঠুনকে যথেষ্ট সম্মান দেওয়া শুরু করলেন। সবচেয়ে বিপদ হল যখন ক্লাশে এসে কালাপাহাড় স্যার মিঠুনকে বলতে শুরু করলেন, “এই মিঠুন, তুই ক্লাশটা পড়া আমার জরুরী একটা কাজ আছে।”
মিঠুন খুব উৎসাহ নিয়ে আমাদের বিজ্ঞান পড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু কয়েকদিনের মাঝেই আমরা আবিষ্কার করলাম সে ভালো বিজ্ঞান জানতে পারে কিন্তু সে মোটেও পড়াতে পারে না। সোজা জিনিষটা এমন জটিল করে বলে যে আমরা মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝি না। আমরা যখন কিছু একটা বুঝি না সে তখন আরো রেগে উঠতে থাকে আর যখন সে রেগে উঠে তখন মিঠুনের কথা বার্তাও ওলট পালট হতে থাকে। মিঠুনের ওপর ভর দিয়ে বিজ্ঞান স্যার আজকাল বেশীর ভাগ সময়েই ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিলেন। তখন মিঠুনকে নিয়ে সমস্যা আরো বেড়ে গেল। কেউ মিঠুনের কোনো কথা শুনতে রাজী হতো না—সবাই মিলে হই চই চেঁচামেচি করে মিঠুনকে নিয়ে টিটকারী মারতে শুরু করল। আমরা আগেও কোনো স্যার থেকে কিছু শিখতাম না এখনো মিঠুনের কাছ থেকে কিছু শিখি না তাই আমাদের জীবনের কোনো উনিশ বিশ হল না।
ক্লাশে আমাদের বিজ্ঞানের কোনো কিছু বোঝাতে না পারলেও মিঠুন ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা নিয়ে তার গবেষণা কাজ ভালোই চালিয়ে গেল। এনার্জি, মোমেনটাম, গ্রাভিটি, থ্রাস্ট, লিফট, সেন্টার অফ গ্রেভিটি এরকম অনেক কঠিন কঠিন শব্দ বলতে বলতে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা নিয়ে কাজ করতে থাকে। কী তৈরী করছে সেটা আমাদের পরিষ্কার করে বলে না, কিংবা কে জানে হয়তো বলেছে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে আমরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না, মিঠুনের উপর আমাদের অনেক ভরসা। সে যেটা বানাচ্ছে তার জন্যে মাঝে মধ্যে কিছু কেনাকাটা করতে হচ্ছে— হেড স্যার যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আগে তার বিশেষ কিছু খরচ হয়নি। এখন সেখান থেকে টাকা ব্যবহার করে মিঠুন প্রায়ই এটা সেটা কেনে। ল্যাবরেটরির ভেতরের ভাঙ্গা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে—একদিন দেখলাম সিড়ির নিচে পড়ে থাকা ভাঙ্গা কিছু চেয়ার টেবিল টানাটানি করছে। সেগুলো দিয়ে কী করবে কে জানে! আমরা অবশ্যি বেশি মাথা ঘামালাম না, মিঠুন ভাঙ্গা চেয়ার টেবিলগুলো কোথায় নিতে চায় তার কাছ থেকে শুনে আমরা ধরাধরি করে সেখানে পৌঁছে দিলাম।