“কত হাইভোল্টেজ দাও?”
“পুরান টেলিভিশনের ফ্লাই হুইল ব্যবহার করেছি–তার মানে কয়েক হাজার ভোল্ট।”
মধ্যবয়স্ক প্রফেসর বললেন, “কয়েক হাজার ভোল্টে এরকম প্লাজমা তৈরী হয় না।”
মিঠুন একটু ঢোক গিলে বলল, “শুধু হাই ভোল্টেজ দিই না স্যার আরো কিছু ব্যবস্থা করেছি।”
“কী করেছ?”
“প্রথমে একটা ফিলামেন্ট বেরিয়াম অক্সাইড দিয়ে কোট করেছি (মিথ্যা কথা), সেটাকে স্যার কারেন্ট দিয়ে গরম করি (ভূয়া তথ্য), ফিলামেন্ট গরম হলে ইলেকট্রন এমিট করে (তথ্যটা সত্যি হতে পারে
এখানে করা হয় নাই, সেই ইলেকট্রন কাছাকাছি বাতাসকে আয়োনাইজ করে (সম্ভব কিনা কে বলবে?), তখন একটা হীটার বাতাসকে প্রি-হিট করে (পরিষ্কার মিথ্যা কথা), একটা ফ্যান সেই বাতাসকে ব্লো করে ছোট একটা ফ্যান আছে শুধু সাউন্ড এফেক্টের জন্যে, প্রিহিটি বাতাস অনেকগুলো হাইভোল্টেজ গ্রীড়ের ভিতর দিয়ে যায় (ভূয়া ভূয়া চরম ভূয়া) তখন পাজমাটা তৈরী হয়।”
মিঠুন কোনো প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দিয়ে টানা কথা বলে গেল, আমি মিঠুনের এরকম বৈজ্ঞানিক ভূয়া কথা বলার ক্ষমতা দেখে চমৎকৃত হলাম। ভেবেছিলাম এরকম বৈজ্ঞানিক কথা শুনে বিচারক তিনজন বুঝি সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু মাঝবয়সী প্রফেসরদের একজন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলেন না। মাথা চুলকে বললেন, “তুমি যেভাবে বলেছ সেভাবে তো এরকম ভায়োলেন্ট প্লাজমা হবার কথা। ছোটখাটো স্পার্ক হতে পারে কিন্তু তাই বলে ছয়সাতফুট লম্বা এরকম বিশাল প্লাজমা তাও এটমস্ফিয়ারিক প্রেসারে ইম্পসিবল।”
মিঠুন বলল, “কিন্তু স্যার, আপনি তো দেখছেন— এটা হচ্ছে! আপনার চোখের সামনে হচ্ছে। যদি সম্ভব হত তাহলে পুরোটা খুলে দেখাতাম স্যার?”
বিচারকরা মাথা চুলকালেন। মিঠুন বলল, “শুধু একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি।”
“কী জিনিস?”
“বাতাসটাকে যে চেম্বারে প্রিহিট করি সেই চেম্বারের ভিতরে একটা জিনিসের প্রলেপ দিয়েছি। মনে হয় সেই জিনিসটার জন্যে এত সহজে বাতাসের অনু পরমাণু আয়োনাইজ করা হয়।”
তিনজনই এবার আগ্রহী হল, “কী জিনিস”
“অনেক ট্রায়াল এন্ড এরর করে বের করেছি স্যার। এর মাঝে ঠিক কী আছে পরিষ্কার করে জানি না। যদি এটমিক মাস প্রেকটাম এনালাইজার থাকত বলতে পারতাম।”
মাঝ বয়সী প্রফেসর বললেন, “ভেরি স্ট্রেঞ্জ।”
অন্যজন বললেন, “কিন্তু নিজের চোখে দেখছি। অবিশ্বাস করি কী করে?”
প্রথমজন বললেন, “এটা অবশ্যি খুবই বিপজ্জনক। এই প্লাজমা নড়তে চড়তে গিয়ে যদি কারো শরীরে লাগে তাহলে মেজর একসিডেন্ট হবে।”
মিঠুন বলল, “আপনারা দেখার পর বন্ধ করে রাখব স্যার।”
“সেটাই ভালো।”
তারপর তারা তাদের হাতে লেখা কাগজটাতে প্রজেক্টের মার্কস লিখে হুঁটিতে শুরু করল। কতো দিয়েছে দেখার জন্য আমি ইতি উতি চেষ্টা করলাম, লাভ হল না। তারা যখন হাঁটছে আমি পিছু পিছু গেলাম, শুনলাম একজন আরেকজনকে বলছে, “আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।”
অন্যজন বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি। শুধু মাত্র এনার্জী কনজারভেশানের কথা ধর–এটমস্ফিয়ারিক প্রেশারে এ রকম ভায়োলেন্ট একটা প্লাজমা তৈরী করতে কী পরিমাণ এনার্জী লাগবে কল্পনা করতে পার? সেই এনাজটা কোথা থেকে আসছে? পুরান টেলিভিশনের ফ্লাই ব্যাক সেটা দিতে পারে? অসম্ভব!”
“তাহলে?”
“সেটাই তো সমস্যা! এই বাচ্চা এটা তৈরি করল কেমন করে?”
তবে বাচ্চাটা কিন্তু জানে। তার কথাবার্তা বাচ্চাদের মত না, বড় মানুষের মত। সায়েন্স ফেয়ারটা শেষ হলে বাচ্চাটার যন্ত্রটাকে নিয়ে বসতে হবে। কীভাবে কাজ করে দেখতে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার কেন জানি মনে হয়—”
“কী মনে হয়?”
“বাচ্চাটা যেটুকু বলেছে তার বাইরেও কিছু একটা আছে। সে আমাদের পুরোটুকু বলেনি।”
“তোমার তাই ধারণা?”
“হ্যাঁ। বাচ্চাটা তো বোকা না, সে সবকিছু জানে। সে যে আমাকে বলেনি তারও নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে।”
“কী কারণ?”
প্রফেসর মানুষটি তখন গলা নামিয়ে কথা বলতে লাগল, তাই আমি আর তাদের কথাগুলো শুনতে পেলাম না। যেটুকু শুনেছি সেটাই যথেষ্ট। আমি প্রায় দৌড়ে মিঠুনের কাছে এলাম। তার হাই প্রেশার জমা ঘিরে শত শত মানুষ গিজ গিজ করছে। সবাই দেখতে চাইছে। বগা, গুললু, ঝুম্পা মিলে সবাইকে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে আর মিঠুন তখন তার যন্ত্র চালু করছে। বিস্ফোরণের মত শব্দ করে লকলকে প্ৰাজমা ছাদ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। কাছাকাছি অক্সব্রীজ স্কুলের প্রজেক্টের সামনে কেউ নেই, তারা গালে হাত দিয়ে শুকনো মুখে বসে আছে।
আমি মিঠুনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “মিঠুন—”
“কী হয়েছে?”
“বিচারক প্রফেসররা টের পেয়ে গেছে “কী টের পেয়েছে?”
“এখানে আসলে অন্য কিছু আছে, তুই তাদের পুরোটা বলিসনি। গোপন করেছিস।”
মিঠুন আমার কথা শুনে অবাক হল না, বলল, “টের পেতেই পারে। যে কোনো মানুষ যদি একটুখানি বিজ্ঞান জানে তাহলেই টের পেয়ে যাবে।”
আমি ফিসফিস করে বললাম, “সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর তারা যন্ত্রটা আবার দেখতে আসবে।”
“আসুক।” মিঠুন বলল, “আমি ততক্ষণে এটা খুলে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটাকে সরিয়ে দিব।”
বিচারকরা সবগুলো প্রজেক্ট দেখার পরই সায়েন্স ফেয়ার শেষ হয়ে গেল। সবাই নিজেদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিচ্ছে, তখন মিঠুনও সাবধানে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চটাকে খুলে তার পকেটে ভরে নিল। সেই জায়গায় সে আরেকটা ছোট বোতল রেখে দিল। বোতলটা একেবারে খালি রাখলে কেমন দেখায়? কী রাখা যায় সেটা নিয়ে যখন চিন্তা করছে তখন আমি আমার মুখের ভিতর থেকে চিউয়িং গামটা বের করে মিঠুনকে দিলাম। “নে। এটা রেখে দে।”