“ভূয়া?”
“হ্যাঁ। এইগুলো লাগিয়ে দিয়েছি যেন কেউ আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে।”
“আসল ব্যাপার?”
“হ্যাঁ, আমি সবাইকে বোঝাব খুব হাই ভোল্টেজ দিয়ে পাজমা তৈরী হয়।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম “বুঝতে পারলাম। তুই কাউকেই আসল জিনিসটা বলতে চাস না?”
“না! আসল জিনিসটা জানলে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে!”
সকালবেলা মিঠুনের জটিল যন্ত্র নিয়ে আমরা বিজ্ঞান মেলায় হাজির হলাম। টেবিলের উপর রেখে একবার সেটা পরীক্ষা করে দেখা হল। সুইচ টেপা মাত্রই এটা তো শব্দ করতে লাগল। মিঠুন সাবধানে নবটা ঘুরিয়ে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার দুই পাশে ভোল্টেজটা বাড়ানো মাত্রই হঠাৎ ছোট বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হলো আর শিশিটার ছোট মুখ থেকে একটা আগুনের তৈরী সাপের মতো বিশাল একটা শিখা হিস হিস করে বের হয়ে এল। আবছা নীল রংয়ের এই সাপটা দুলতে থাকে। দুলতে দুলতে জীবন্ত প্রাণীর মতো পাজমার তৈরী এই সাপটা ছাদটাকে আঘাত করতে থাকে। ছাদ থেকে পোড়া প্যালেস্তারা ঝুরঝুর করে নিচে পড়তে থাকে আর পুরো টেবিলটা থর থর করে কাঁপতে থাকে। প্লাজমাটার একটা আশ্চর্য শব্দ হয় আর সাথে সাথে সারাঘর বিচিত্র একটা ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে গেল। সবকিছু ঠিক ঠিক কাজ করছে দেখার পর মিঠুন তার নবটা ঘুরিয়ে ভোল্টেজ কমিয়ে আনতেই প্লাজমার জ্বলন্ত শিখাটা সাথে সাথে সর সর করে শিশির ভেতরে ঢুকে গেল।
এই বিচিত্র ব্যাপারটা দেখার জন্যে মুহূর্তের মাঝে চারপাশে ভীড় জমে গেল। লোকজন ছেলে-পিলে অবাক হয়ে বলল, “কী এটা কী?”
মিঠুন বলল, “হাইপ্রেশার প্লাজমা জেনারেটর।”
তার অর্থ কী কেউ বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল,বলল, “দেখাও। আবার দেখাও।”
মিঠুন একটু ইতস্তত করল,বলল, “সবাইকে তাহলে দূরে সরে যেতে হবে। এটা অনেক পাওয়ারফুল–হঠাৎ করে কারো গায়ে লেগে গেলে বিপদ হবে।”
আমরা কয়েকজন মিলে সবাইকে ঠেলে একটু দূরে সরিয়ে দিলাম। মিঠুন আবার সুইচ অন করে ভোল্টেজের নটা ঘুরাতে থাকে, প্রথমে একটু ভেতা শব্দ শোনা গেল হঠাৎ ছোট একটা বিস্ফোরণের মত শব্দ করে সাপের মত লকলকে একটা পাজমার শিখা বের হয়ে আসে। সেটা জীবন্ত প্রাণীর মত কিলবিল করে লড়তে থাকে। আশেপাশে একটা বিচিত্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যারা ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল তারা বিস্ময়ের এবং ভয়ের শব্দ করে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কয়েক সেকেন্ড দেখিয়েই মিঠুন তার হাইপ্রেশার প্লাজমা বন্ধ করে দিল। সবাই তখন ভীড় করে যন্ত্রটা দেখতে এল এবং আমার মনে হলো মিঠুন নানারকম ভূয়া যন্ত্রপাতি দিয়ে যন্ত্রটাকে জটিল করে বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছে। যদি সবাই দেখত ছোট একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি থেকে এই ভয়ঙ্কর প্লাজমী বের হয়ে আসছে তাহলে তারা নিশ্চয়ই এতো চমৎকৃত হত না।
মিঠুনের হাই-প্রেশার প্লাজমা দেখার জন্যে মানুষ ভীড় করতে থাকে। তাকে একটু পরে পরে সেটা দেখাতে হয়। আমি গলা নামিয়ে বললাম, “এতবার দেখাস না, হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে বিপদ হবে। বিচারকদের আগে ভালো করে দেখিয়ে নে।”
মিঠুন ফিসফিস করে বলল, “দেখানো নিয়ে সমস্যা নাই। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু বোঝাব কেমন করে? ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার কথা তো বলা যাবে না–”
আমি মিঠুনকে সাহস দিলাম “বোঝাবুঝির কী আছে? জিনিসটা দেখবে। দেখলেই তো হলো।”
মিঠুনকে তারপরেও কেমন যেন নার্ভাস দেখাল। সে কেন নার্ভাস ছিল সেটা আমি একটু পরেই বুঝতে পারলাম। বিচারকেরা সবার প্রজেক্ট দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছেন, তারা এর মাঝেই মিঠুনের হাই-প্রেশার প্লাজমা প্রজেক্টের খবর পেয়েছেন তাই ছোটখাটো প্রজেক্টে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি মিঠুনের কাছে চলে এলেন।
বিচারকদের দলে তিনজন মানুষ, একজন একটু কম বয়সী অন্য দুইজন মাঝবয়সী, তাদের চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা। দুজনেই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, তাদের সাথে আরো উৎসাহী লোকজন আছে, আমি দেখলাম অক্সব্রীজ স্কুলের সায়েন্স টিচারও পিছন পিছন এসেছেন। মাঝবয়সী একজন প্রফেসর গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা কী?”
মিঠুন কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “হাই-প্রেশার পাজমা।”
“হাই-প্রেশার?”
“আসলে সবাই লো প্রেশারে প্লাজমা তৈরী করে। এটা যেহেতু এটমস্কিয়ারিক প্রেশারে তৈরী হয়েছে সে জন্যে বলছি হাই-প্রেশার। আসলে বলা উচিত ছিল এটমস্ফিয়ারিক পাজমা।”
মাঝবয়সী প্রফেসর বললেন, “সমস্যা নাই। নামে কী আসে যায়? দেখাও এটা কী করে।”
মিঠুন কঁপা হাতে সুইচ অন করে নবটা ঘোরালো, সাথে সাথে ছোট একটা বিস্ফোরণের মত শব্দ করে লকলক করে প্রাজমাটা বের হয়ে হিসহিস শব্দ করে জীবন্ত একটা প্রাণীর মত ছাদকে স্পর্শ করল। প্লাজমা থেকে নীলাভ আলোটা সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আর বিচারকেরা ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলেন। তারা হতভম্বের মত সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। একজন চাপা গলায় বললেন, “ও মাই গড!”
আরেকজন বললেন, “এটা কীভাবে সম্ভব?”
প্রথমজন মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তু-তুমি বানিয়েছ?”
“আমি একা না। আমরা বন্ধুরা মিলে বানিয়েছি।”
আমি একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ালাম, চুল ঠিক করলাম, ছোট করে কাশলাম যেন সবাই বুঝতে পারে মিঠুন যেসব বন্ধুর কথা বলেছে আমি তাদের একজন।
কমবয়সী বিচারক জিজ্ঞেস করল, “এটা কীভাবে কাজ করে?”
মিঠুন বলল, “হাইভোল্টেজ দিয়ে বাতাসকে আয়োনাইজ করে ফেলি।”