ছেলেমেয়েগুলো তখন খুব রেগে ইংরেজীতে গালাগাল দিতে শুরু করেতই ঝুম্পা গরুর মতো করে ডাকলো, “হাম্বা-হাম্বা!” তারপর চলে এল।
এরপর আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরাও একজন একজন করে অকুব্রীজ স্কুলের প্রজেক্ট দেখতে গেল আর তার কথা শুরু করতেই আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা গরুর মত করে ডাকতে শুরু করল, “হাম্বা-হাম্বা–
তখন যা একটা মজা হল সেটা বলার মত না। শুধু যে আমরা অব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদেরকে হাম্বা করে ডাকতে লাগলাম তা নয়, বিজ্ঞান মেলার অন্যান্য স্কুলের ছেলেমেয়েরাও তাদের দেখে গরুর মত হাস্থা হাম্বা করে ডাকতে লাগল। আমরা যেরকম অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখতে পারি না সেরকম মনে হয় অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরাও অক্সব্রীজ স্কুলকে দেখতে পারে না। আমরা তাদের সবাই মিলে এতই জ্বালাতন করলাম যে তখন তাদের একজন টিচার তাদের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীদেকে নিয়ে আমাদের কাছে এল, আমরা দেখলাম এটা সেই সায়েন্স টিচার।
মিঠুনের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “মিঠুন তোমাদের টিচাররা কোথায়?
মিঠুন উত্তর দেবার আগেই ঝুম্পা উত্তর দিল, “আমাদের কোনো টিচার আসে নাই।”
সায়েন্স টিচার তখন মিঠুনকে বললেন, “যেহেতু তোমাদের স্কুলের কোনো টিচার নেই তাহলে আমি তোমাকেই বলি। তোমরা যেটা শুরু করেছ সেটা মোটেও গ্রহণযোগ্য কাজ না।”
কথাটা সত্যি। তাই আমরা চুপ করে রইলাম।
“স্যায়েন্স ফেয়ারে সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে আসার কথা। তোমরা সেরকম প্রজেক্ট আননি। তোমরা কিছু তামাশা নিয়ে এসেছ। সারাদিন ধরে তামাশা করে বেড়াচ্ছ। আমি তোমাদের নামে কমপ্লেন করব যেন ভবিষ্যতে তোমাদের আসতে না দেয়।”
কথাগুলো সত্যি তাই আমরা চুপ করে থাকলাম। সায়েন্স টিচার বললেন, “মিঠুন, তুমি যতদিন আমাদের স্কুলে ছিলে আমরা তোমার সায়েন্স প্রজেক্ট দাড়া করাতে সাহায্য করেছি। অন্যান্য বছর অক্সব্রীজ স্কুলের পক্ষ থেকে তুমি চ্যাম্পিয়ান হয়ে পুরস্কার এনেছ। এখন দেখো তোমার অবস্থা। তুমি কি করছ? কিছু বেয়াদপ ছেলেমেয়ে নিয়ে হাম্বা হাম্বা করে বেড়াচ্ছ। ছিঃ মিঠুন ছিঃ। আমি খুবই দুঃখিত হলাম।”
কথাগুলো সত্যি কিন্তু চুপ করে থাকা কঠিন। তারপরেও চুপ করে রইলাম আর দেখতে পেলাম মিঠুনের মুখটা লজ্জায় কেমন যেন কালো হয়ে গেল।
সায়েন্স টিচার এখানেই থামলেন না, বলতে থাকলেন, “কালকে বড় বড় ইউনিভার্সিটির বড় বড় প্রফেসররা প্রজেক্টগুলো দেখতে আসবে। তারা কী তোমাদের তামাশা প্রজেক্টকে কোনো গুরুত্ব দেবে? না, দেবে না। তুমি কিংবা তোমার স্কুল কোনো পুরস্কার পাবে না। কোন স্কুল চ্যাম্পিয়ন হবে? আমাদের স্কুল। তার কারণ আমাদের স্কুলের প্রজেক্ট হচ্ছে সত্যিকারের প্রজেক্ট। আমরা তৈরি করেছি ভ্যান ভি গ্রাফ জেনারেটর। সোলার পাওয়ার্ড কার। সিনথেসিস অফ ডিজেল অয়েল। বুঝেছ মিঠুন, ভেবেছিলাম তুমি একদিন সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমার ধারণা ভুল। তুমি আসলে সায়েন্টিস্ট হবে না। তুমি কিছু বেয়াদপ ছেলেমেয়েদের সাথে থেকে বেয়াদপ একজন মানুষ হয়ে বড় হবে। তুমি আর তোমার বন্ধুরা এসে সায়েন্স ফেয়ারের মতো সুন্দর একটা পরিবেশকে নষ্ট করে দিবে।”
কথাগুলো সত্যি তাই আমরা চুপ করে রইলাম।
স্যায়েন্স টিচার বললেন, “তুমি যখন আমাদের স্কুলে ছিলে তখন তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। আজকে তোমাকে নিয়ে আমি লজ্জা পেলাম।”
স্যায়েন্স টিচার চলে যাবার পর মিঠুন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ঝুম্পা বলল, “কতো বড় সাহস। আমাদের স্যার ম্যাডামেরা আমাদের সাথে কথা বলতে সাহস পায় না। আর অন্য স্কুল থেকে একজন মাস্টার এসে আমাদের বকে যাবে? কতো বড় সাহস?”
বগা বলল, “গুললুকে বলি ওদের প্রজেক্ট গুড়ো করে দিয়ে আসুক।”
মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “না না। খবরদার। তাছাড়া
“তাছাড়া কী?”
“স্যার তো ভুল বলেননি। সত্যি কথাই বলেছেন। ওদের প্রজেক্ট কতো ভালো। নিশ্চয়ই কয়েক মাস থেকে কাজ করেছে, স্যারেরা সাহায্য করেছে। প্রজেক্টের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করেছে। আসলেই তো আমরা কোনো পুরস্কার পাব না। আমাদের প্রজেক্টগুলো তো আসলেই তামাশা।”
বিকেল বেলা আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি তখন আমি নিচু গলায় মিঠুনকে বললাম, “মিঠুন।
মিঠুন বলল “কী?”
“তুই আসলেই বিজ্ঞান মেলায় চ্যাম্পিয়ন হতে চাস?”
“হতে চাইলেই কী হওয়া যায়? তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়।”
আমি ফিস ফিস করে বললাম, “তোর ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা নিয়ে আয়, তুই চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাবি।”
“ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা?”
“হ্যাঁ।”
কাজেই পরের দিন সবাই প্রথমবার ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাকে দেখতে পেল।
০৭. বাসার চিলেকোঠায়
আমার মনে আছে আমাদের বাসার চিলেকোঠায় মিঠুন কতো সহজে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা থেকে লকলকে জিবের মতোন প্লাজমা বের করে ফেলেছিল, তাই আমি ভেবেছিলাম সে বুঝি খুব সহজেই বিজ্ঞান মেলায় সেটা করতে পারবে। কিন্তু বেশ অবাক হলাম যখন দেখলাম তার প্রজেক্টটা দাড় করাতে অনেক সময় লাগল। আগের রাত একেবারে বারোটা পর্যন্ত কাজ করতে হলো। পরের দিন সকালেও তার কাজ করতে হল, শেষ পর্যন্ত যখন বিজ্ঞান মেলায় সেটা দেখার জন্যে রেডি হল আমি সেটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এর ভেতরে পুরান টিভির যন্ত্রপাতি, কম্পিউটারের ড্রাইভের চুম্বক, প্রিন্টারের রোলার, এলার্ম ক্লাকের মোটর–এক কথায় এমন কোনো যন্ত্র নেই যেটা সেখানে নেই। আমি অবাক হয়ে বললাম, “আরে! এটা কী তৈরী করেছিস? এতো যন্ত্রপাতি কেন?” মিঠুন গলা নামিয়ে বলল, “এইখানে যা আছে তার বেশিরভাগ ভূয়া।”