এরকম সময় আমি মিঠুনকে ফিস ফিস করে বললাম, “খামোখা আলোচনা করে লাভ নাই। তুই কয়েকটা ঠিক করে দে, যার যার ইচ্ছা তারা সেটা নিয়ে যাবে।”
শেষ পর্যন্ত সেটাই করা হল। মিঠুনের মাথায় বিজ্ঞানের প্রজেক্ট কিলবিল কিলবিল করছে। আমরা সেখান থেকে বেছে বেশ কয়েকটা নিয়ে সেগুলো তৈরি করতে শুরু করলাম। মিঠুন যখন বলেছে তখন বিষয়টাকে খুবই সোজা মনে হয়েছে, তৈরী করার সময় দেখা গেল জিনিষগুলো আসলে তত সোজা না। তব যন্ত্রপাতির ব্যাপারে মিঠুনের হাত খুব ভালো। সে সত্যি সত্যি প্রজেক্টগুলো দাড়া করে ফেলল।
যেদিন বিজ্ঞান মেলা শুরু হবে আমরা সবাই প্রজেক্টগুলো নিয়ে হাজির হয়েছি। সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মেলা। সকালে উদ্বোধন অনুষ্ঠান। উদ্বোধন করবে ভিসি না যেন কে। আমাদেরকে বড় একটা হল ঘরে বসিয়ে রাখল, কিন্তু ডিসি সাহেবের দেখা নেই। আমরা গরমে প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেলাম, পাকা দেড়ঘণ্টা পর ডিসি সাহেব আসলেন। তারপর শুরু হল বক্তৃতা। বিজ্ঞান যে কতো ভালো সবাই ইনিয়ে বিনিয়ে সেইগুলো বলতে শুরু করল-শুনে শুনে আস্তে আস্তে আমাদের মেজাজ গরম হতে থাকে, কিন্তু কিছু করার নাই তাই চুপ করে সহ্য করলাম। তারপর শুরু হল ডিসি সাহেবকে তেল দেওয়া বক্তৃতা, তিনি এতো ব্যস্ত মানুষ তারপরও সময় করে এসেছেন সে জন্যে পারলে একেকজন তার পায়ে চুমো খেতে শুরু করে।
সবার শেষে ডিসি সাহেব বক্তৃতা শুরু করলেন। ছোট থাকতে তিনি কতো ভালো ছাত্র ছিলেন, কোন পরীক্ষায় কতো মার্কস পেয়েছিলেন, তখন তার স্যারেরা কীভাবে তার সম্পর্কে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে, এবং তার জীবন থেকে আমাদের কতো কী শেখার আছে সেটা বলতে শুরু করলেন। বক্তৃতা যখন শেষ হল তখন আমরা সবাই নেতিয়ে পড়েছি, এমন খিদে পেয়েছে যে মনে হচ্ছে ডিসি সাহেবকে ধরে কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলি।
ডিসি সাহেব আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা তখন হলঘরে বিজ্ঞানের প্রজেক্টগুলো দেখতে গেলেন। অক্সব্রীজ স্কুলের কয়েকটা প্রজেক্ট দেখলেন, ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তোলা হল। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথা বললেন, তারপর চলে গেলেন।
বিকেল বেলা স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মা আত্মীয় স্বজন আর শহরের পাবলিক বিজ্ঞান মেলা দেখতে এল। আমরা লক্ষ করলাম আমাদের প্রজেক্টগুলোতে মানুষের বেশী কৌতূহল নাই, মিঠুন অনেক চিন্তা ভাবনা করে একেবারে খাঁটি বিজ্ঞানের প্রজেক্ট তৈরি করেছে (আলো কেন তরঙ্গ, আকাশ কেন নীল, চৌম্বক ক্ষেত্রে চার্জ কেন বল অনুভব করে। কিন্তু সাধারণ পাবলিকরা সেগুলো দেখতে চায় না। মিঠুন আমাদের সবকিছু মুখস্ত করিয়ে এনেছে আমরা সেগুলো বলার চেষ্টা করি কিন্তু পাবলিক সেগুলো না শুনেই সুড়ুৎ করে সরে যায়।
পাবলিকের ভীড় অক্টব্রীজ স্কুলের প্রজেক্টগুলোর সামনে, তাদের প্রজেক্টগুলোতে বিজ্ঞান খুব কম মজা অনেক বেশী। যেমন একটা ছেলে রবোট সেজে এসেছে। কার্ডবোর্ড দিয়ে শরীর ঢাকা, মাথার ওপর বুকের মাঝে বাতি জ্বলছে। সে রবোটের মতন হাঁটে, মাথা নাড়ে কথা বলে সব পাবলিক সেই রবোটের পিছনে পিছনে ঘুরে। শুধু তাই না সেই রবোটটা হেঁটে হেঁটে আমাদের প্রজেক্টগুলোর পাশে দাঁড়াল। তারপর রবোটের মত গলায় বলল, “ম-হ-ব-ব-ট জান-ই-শ-কু-ল-কী-ফা-নি-হা-হা-হা।”
শুধু তাই না তারপর আমাদের প্রজেক্টগুলো দেখে ভান করল যে তার ব্রেনের সার্কিট উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। রবোটের সাথে সাথে অক্সব্রীজ স্কুলের কয়েকটা ছাত্রছাত্রী ছিল। মিঠুন তাদের বলল, “এটা বিজ্ঞান মেলা। তোমরা একটা ক্লাউনকে রবোট সাজিয়ে এনেছ কেন? এটা কী বিজ্ঞান হয়েছে?”
ছেলেমেয়েগুলো নিশ্চয়ই মিঠুনকে আগে থেকে চিনে, একজন ইংরেজীতে বলল, “মিঠুন তুমি ভুলে গেছ আমরা সব সময় এটা করি। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যে একটা ফান প্রজেক্ট করি। এটা সেই ফান প্রজেক্ট।”
আরেকজন বলল, “তোমার সেন্স অফ হিউমার চলে গেছে।”
সুন্দর টিস টসে একটা মেয়ে বলল, “তুমি যে স্কুলে গেছ সেখানে সেন্স অফ হিউমার তো অনেক পরের ব্যাপার কোনো সেন্সই তো থাকার কথা না।”
আরেকজন বলল, “তোমার কী এখন যথেষ্ট মহব্বত হয়েছে?” তারপর সবাই হি হি করে হাসতে লাগল।।
মিঠুন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল, ঝুম্পা বলল, “মিঠুন, দিব একটা রা? জন্মের মতো বাপের নাম ভুলিয়ে দিব?”
মিঠুন মাথা নাড়ল বলল, “না, না খবরদার।”
বিকেলবেলা আমরা যখন প্রজেক্টগুলো গুছিয়ে ফিরে যাচ্ছি তখন মিঠুনকে খুবই মনমরা দেখা গেল! আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
মিঠুন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ কিছু না।”
আমি বললাম, “তুই খামোখা সায়েন্সের প্রজেক্টগুলো করেছিস। কেউ সায়েন্স প্রজেক্ট দেখতে চায় না–ঠাট্টা তামাশা দেখতে চায়। অক্সব্রীজ স্কুলের মত আমাদের রবোট ফবোট বানানো উচিত ছিল।”
ঝুম্পা বলল, “এখনো সময় চলে যায় নাই। কাল পরশু সময় আছে।”
বগা বলল, “এতো কম সময়ে নূতন কিছু করা যাবে?”
আমি বললাম, আসল প্রজেক্ট করা যাবে না। কিন্তু ইয়াকী মার্কা প্রজেক্ট করতে সমস্যা কী?”
মিঠুন চোখ কপালে তুলে বলল, “ইয়াকী মার্কা? ইয়াকী মার্কা সায়েন্স প্রজেক্ট হয় নাকি?”
আমি বললাম, হয় একশবার হয়।”