যেমন ধরা যাক আমাদের রুম্পার কথা। তার বাবা মা আছে না নাই, থাকলেও কোথায় আছে সেটা কেউ জানে না। রুম্পা তার মামীর বাসায় থাকে, মামা মামী অপেক্ষা করছে কখন সে একটু বড় হবে, তখন ঝপ করে তাকে বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করে দেবে। তবে কাজটা খুব সহজ হবে না। ঝুম্পাকে কেউ যদি জোর করে বিয়ে দিতে চায়, তাহলে ঝুম্পা শুধু যে তার নূতন জামাইকে মার্ডার করে ফেলবে তা নয়। নূতন শ্বশুর শাশুড়ী এমনকি বিয়ের কাজী আর উকিল বাবাকেও মার্ডার করে ফেলবে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই পত্রিকার হেডলাইন হবে এরকম : “হিংস্র নববধূ কর্তৃক জামাতা ও শ্বশুর শাশুড়ী খুন! মৃত্যুর সাথে লড়ছেন কাজী এবং উকিল বাবা।” কিংবা “রক্ত পিপাসু নববধূ, বিয়ের আসরে গণহত্যা।” অনেকেই মনে করতে পারে কথাগুলো বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলা হচ্ছে-আসলে এক বিন্দুও বাড়ানো হয়নি। যেমন ধরা যাক গত সপ্তাহের ঘটনাটা, ঝুম্পা স্কুলে আসছে চৌরাস্তার মোড়ে ভিডিওর দোকানের সামনে একটা লাফাংরা ছেলে ঝুম্পাকে লক্ষ্য করে কী একটা বাজে কথা বলল। অন্য যে কোনো মেয়ে হলে কথাটা নাশোনার ভান করে হেঁটে চলে যেতো, ঝুম্পা সেরকম পাত্রই না, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “এই পাংকু, তুই কী বললি?
ছেলেটা একবারে হকচকিয়ে গেল, সে কল্পনাও করতে পারেনি একা একটা মেয়ে এইভাবে কথা বলবে। ছেলেটা মাস্তান টাইপের, নিজেকে সামলে নিয়ে হলুদ দাঁত বের করে হাসার ভাণ করে বলল, “শুনতে ভালো লেগছে? আবার শুনবার চাও?”
ঝুম্পা তখন তার ব্যাগটা নিচে রেখে সেখান থেকে একটা লাল রুমাল বের করে মাথার মাঝে বাধল, তারপর ওড়নাটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষকে বলল, “আংকেল, আমার ব্যাগটা একটু দেখবেন।” তারপর দুই হাত দিয়ে ছেলেটার চোখ দুটি তুলে নেবার একটা ভঙ্গী করে এগিয়ে গেল।
ঝুম্পার চেহারা ভালো না খারাপ সেটা আমরা কেউই পরিষ্কার ভাবে বলতে পারি না, অন্য দশটা মেয়ের মত চুলে শ্যাম্পু ট্যাম্পু দিয়ে সেজেগুজে থাকলে মনে হয় ভালো হিসাবে চালানো যায়, কিন্তু যে যখন মাথার মাঝে লাল রংয়ের একটা রুমাল বেঁধে দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে যায় তখন তার দুই চোখের দিকে তাকালেই মানুষের আত্মা উড়ে যায়। মাস্তান ছেলেটারও আত্ম উড়ে গেল, তাই নূতন কোনো গোলমাল না করে সে সরে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে সরে যাবার চেষ্টা করলেই তো হবে না, ঝুম্পারও তো তাকে সরে যেতে দিতে হবে। ঝুম্পা তাকে সরে যেতে দিল না, পিছন পিছন গিয়ে বলল, “এই পাংকু, কই যাস? কী বললি আরেকবার বল দেখি।”
পাংকু আরেকবার বলার কোনো আগ্রহ দেখাল না, তাড়াতাড়ি হেঁটে পাশের গলিতে ঢোকার চেষ্টা করল, পিছন পিছন ঝুম্পাও এগিয়ে গেল, পাংকু তখন নার্ভাস হয়ে দৌড় দেবার চেষ্টা করল ঝুম্পা তখন হুংকার দিয়ে বলল, “ধর পাংকুকে” তারপর তাকে ধাওয়া করল। চৌরাস্তা থেকে ধাওয়া করে মহব্বত মার্কেটের সিঁড়ির তলায় ঝুম্পা শেষ পর্যন্ত পাংকুকে মাটিতে চেপে ধরেছিল। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা একটা মেয়ে লাফাংরা টাইপের একটা ছেলেকে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটা মার্কেটের সিঁড়ির নিচে চেপে ধরার ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না, তাই কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে অনেক ভীড় জমে গেল এবং সবাই মিলে ছেলেটাকে উদ্ধার করল, তা না হলে সেই ছেলের কপালে অনেক দুঃখ ছিল। কেউ যেন মনে না করে আমাদের স্কুলের সব মেয়েই ঝুম্পার মতোন জঙ্গী টাইপের, সেটা সত্যি নয়। ঝুম্পা একটু বেশী অন্যরকম। অন্য মেয়েরা প্রায় স্বাভাবিক, যেমন ফারা খুবই নরম স্বভাবের মেয়ে, হাসিখুশী, মিষ্টি স্বভাবের, পৃথিবীর সবার জন্যে তার ভালোবাসা দেখে মনে হয় সে বুঝি একটা ছোটখাটো মাদার টেরেসা, শুধু মাত্র বেগম রোকেয়াকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না। তার নাম শুনলেই সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, দাঁত কিড়মিড় করে বলে, “এই মহিলার জন্যে আজ আমার এই অবস্থা।”
প্রথমবার যখন শুনেছিলাম তখন আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী অবস্থা? বেগম রোকেয়া কী করেছেন?”
“কী করেছেন মানে? তার জন্যেই তো মেয়েদের লেখাপড়া করতে হচ্ছে। না হলে আজ আমরা কতো আরামে থাকতে পারতাম। কোনো লেখাপড়া করতে হতো না।”
ফারা যখন এটা বলছে তখন দেখলাম অনেক মেয়ে মাথা নাড়ছে, ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া বেঁচে নাই। বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখলে নিশ্চয়ই অনেক মন খারাপ করতেন।
একদিক দিয়ে মেয়েদের অবস্থা আমাদের থেকে ভালো, তারা বেগম রোকেয়াকে দোষ দিয়ে মনটা হালকা করতে পারছে, আমাদের সেই কপাল নাই, কাউকে দোষ দিতে পারি না। তবে এই ব্যাপারে বগার একটা থিওরি আছে। বেগম রোকেয়ার উপর ফারা আর অন্যান্য মেয়েরা যতই রেগে থাকুক এখন নাকী তারাই বেশী লেখাপড়া করছে। বগা বলেছে সে নাকী কোন পত্রিকায় পড়েছে যে লেখাপড়াটা আস্তে আস্তে মেয়েদের কাছে চলে যাচ্ছে, এই ভাবে আর কিছুদিন গেলে নাকী ভাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, পুলিশ, মিলিটারি, জজ, ব্যারিস্টার, অফিসার সব কিছু হবে মেয়ে। তখন ছেলেদের আর কিছুই করতে হবে না। ভালো দেখে চালাক চতুর একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেললেই সারা জীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত। মেয়েটা চাকরী বাকরী করে টাকা পয়সা উপার্জন করবে, ছেলেরা বাসায় বসে বসে স্পোর্টস চ্যানেলে ক্রিকেট না হলে কুস্তি দেখবে। বগার কথাটা সত্যি হলে খারাপ হয় না, তাহলে আমাদের এতো কষ্ট করে আর লেখাপড়া করতে হবে না।