হেড স্যার এইবার লাফ দিয়ে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, “কথা কানে যায় না। হেই মাইনকা, আমার বেতটা লইয়া আয় তো।”
হঠাৎ পিছন থেকে অপরিচিত একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, কে যেন বলল, “এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নাই। আমি তোমাদের পারমিশান নিয়ে দেব। আমাকে দরখাস্তটা দাও।”
কে কথা বলে দেখার জন্যে আমরা ঘুরে তাকালাম, অবাক হয়ে দেখলাম রোল নাম্বার তেতাল্লিশ দরখাস্তটা নেবার জন্যে হাত বাড়িয়েছে। সে কোনোদিন কথা বলে নাই তাই আমরা কোনোদিন তার গলায় সুর শুনি নাই। মিঠুন কী করবে বুঝতে না পেরে রোল নাম্বার তেতাল্লিশকে দরখাস্তটা দিল। হেড স্যার কেমন যেন ভ্যাবেচেকা খেয়ে গেলেন, তারপরে হুংকার দিয়ে বললেন, “তুই কোন লাটসাহেবের বাচ্চা? তুই কোনখান থাইকা পারমিশান আনবি?”
“হাজী মহব্বতজান আমার চাচা। আমি চাচার কাছ থেকে পারমিশান আনব।”
জোঁকের মুখে চুন পড়লে জোকের যেরকম অবস্থা হয় হেড স্যারের ঠিক সেই অবস্থা হল। এক সেকেন্ডের মাঝে তার মুখটা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হেড স্যার কেমন যেন কাঁপতে লাগলেন, তার মুখটা একবার খুলতে লাগল একবার বন্ধ হতে লাগল। কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “তু-তু-ই মানে তু-তু-তুমি হা-হাজী সাহেবের ভা-ভা-ভাতিজা? সেইটা তো আগে বলবা।”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশ আমাদের বলল, “আয় যাই।”
হেড মাস্টার তখন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “না না যাইও না। দরখাস্তটা দেও আমি সিগনেচার কইরা দেই।” হেড স্যার টেবিলের পিছন থেকে ছুটে আসতে চেষ্টা করলেন, শেলফ টেবিল চেয়ারে ধাক্কা খেলেন, একটা চেয়ার উল্টে পড়ে গেল।
রোল নাম্বার তেতাল্লিশ বলল, “চাচার কাছ থেকে সিগনেচার নিলে ভালো। সায়েন্স ফেয়ারে কিছু খরচ হয়। ভলান্টিয়ারদের খাওয়া দিতে হয় টুকিটাকি যন্ত্রপাতি কিনতে হয় যাতায়াতের খরচ হয়। চাচা সেই ফাটার ব্যবস্থা করে দিবে।”
হেড স্যার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আমি স্কুল ফান্ড থেকে ব্যবস্থা কইরা দিমু।”
তারপর রোল নাম্বার তেতাল্লিশের হাত থেকে দরখাস্ত টা ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে সিগনেচার করে দিলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন, “মানিক্যা আমার সিল আর চেক বইটা তাড়াতাড়ি আন।”
আমরা কিছুক্ষণ পর বিজয়ীর মত হেড স্যারের সিগনেচার সিলসহ দরখাস্ত আর পাঁচ হাজার টাকার একটা চেক নিয়ে বের হলাম। সবাই যখন হই হই করতে করতে যাচ্ছে তখন আমি একটু পিছিয়ে রোল নাম্বার তেতাল্লিশকে ধরলাম। বললাম, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশ কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “হাজী মহব্বতজান আসলে তোর কেউ হয় না, তুই হেড স্যারের রুমে যা বলেছিস সেগুলো পুরোটা বানানো। ঠিক?”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশের মুখে খুবই সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠল। আমি বললাম, “পুরোটা একটা ভাওতাবাজী। ঠিক?”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশের মুখের হাসিটা একটু বিস্তৃত হল। তারপর হ্যাঁ বলার ভঙ্গী করে সে মাথাটা ওপর থেকে নিচে নামাল। আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপল তারপর একটা আঙুল ঠোটের উপর রাখল।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, “ভয় নাই। আমি কাউকে বলব না।”
বছর খানেক পরে রোল নাম্বার তেতাল্লিশ আমাদের স্কুল থেকে চলে গিয়েছিল, এর মাঝে সে আর একটা কথাও বলেনি।
বিজ্ঞান মেলায় যাবার জন্যে অনেক ছেলে মেয়ে ল্যাবরেটরিতে হাজির হল। শুধু ছেলে মেয়ে না, কয়েকজন স্যার ম্যাডামও চলে এলেন। আমরা একটু পরে বুঝতে পারলাম হাজী মহব্বতজান স্কুলের ইতিহাসে যেটা ঘটেনি সেটা ঘটেছে, প্রথমবার স্কুল ফান্ড থেকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করা ছেলেমেয়েদের প্রধান উদ্দেশ্য আর ভাগ বাটোয়ারা করা স্যারদের উদ্দেশ্য।
সবাইকে নিয়ে বসায় কিছুক্ষণের মাঝেই বোঝা গেল বিজ্ঞান মেলা কী জিনিষ, কেমন করে বিজ্ঞান মেলা করতে হয় সেটা নিয়ে মিঠুন ছাড়া আর কারো কোনো ধারণা নেই। বেশীর ভাগ ছেলেমেয়ের ধারণা ছিল এটা যেহেতু মেলা এখানে কিছু একটা বিক্রি করতে হবে। মিঠুন বোঝাল এখানে বিজ্ঞানের প্রজেক্ট না হয় বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে যেতে হবে। সবাই সেটা দেখতে আসবে আর যেটা ভালো হবে সেটাকে পুরস্কার দেয়া হবে।
বিজ্ঞানের কী প্রজেক্ট নেওয়া যায় সেটা নিয়ে প্রথমে একটু আলোচনা করার চেষ্টা করা হল কিন্তু খুব লাভ হল না। যেমন একজন বলল, “আমি একবার ইলেকট্রিক শক খেয়েছিলাম। খুবই আজিব ব্যাপার এক শক খেয়েই আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম, বিজ্ঞান মেলায় তাই আমরা সবাইকে ইলেকট্রিক শক দিতে পারি। খুবই সোজা, খালি পাগপয়েন্ট লাগবে আর একটা তার লাগবে।”
আরেকজন বলল, “একটা গরু নিয়ে যেতে পারি। গরুর গোবর দিয়ে সার তৈরী হয়। গোবরটা কোথা থেকে আসে সবাই দেখতে পারবে। খুবই বৈজ্ঞানিক দৃশ্য।”
আরেকজন বলল, “এক বস্তা তেলাপোকা নিয়ে যেতে পারি। যখন অনেক ভীড় হবে তখন তেলাপোকাগুলো ছেড়ে দিতে পারি, সেইগুলো যখন উড়বে তখন পাবলিক দৌড়াবে। খুবই বৈজ্ঞানিক।”
আরেকজন বলল, “ব্যাঙকে কয়েকটা আছাড় দিলে সেইটা কাহিল হয়ে যায়। তখন সেটা লাফ দিতে পারে না। মানুষের মতো হাঁটে। খুবই বৈজ্ঞানিক দৃশ্য।”
আরেকজন বলল, “লোহার রড় গরম করে ছ্যাকা দিতে পারি। তখন শিক কাবারে মতো গন্ধ বের হয়। সেটা দেখাতে পারি।”