“আমরা স্যার বিজ্ঞানের প্রজেক্ট নিয়ে যাব। যে স্কুলের প্রজেক্ট ভালো হবে সেই স্কুল পুরস্কার পাবে।”
কালাপাহাড় স্যার মিঠুনের কথা শুনে হা হা করে হাসতে শুরু করলেন। আমরা এর আগে কখনো কালাপাহাড় স্যারকে হাঁসতে দেখিনি। তার হাসি দেখে ভয়ে আমাদের আত্মা শুকিয়ে গেল। একজন মানুষ হাসলে তাকে যে এতো ভয়ংকর দেখাতে পারে আমরা সেটা জানতাম না। মিঠুনের কৃথাটা এতোই অবাস্তব যে স্যার তার উত্তরে কিছু বলা দরকার পর্যন্ত মনে করলেন না। হাসতে হাসতে চেয়ারে ঠেলে ঢুকে পড়ে বসে ঘুমিয়ে গেলেন।
ক্লাশের পর মিঠুন বলল, “বিজ্ঞান স্যার যদি রাজী না থাকে তাহলে আমরা হেড স্যারের কাছে যাব।”
বগা জিজ্ঞেস করল, “হেড স্যার? হেড স্যার কে?”
দেখা গেল আমরা কেউই মহব্বতজান স্কুলের হেড স্যার কে সেটা জানি না। এই স্কুল, স্কুলের স্যার ম্যাডাম কোনো কিছু নিয়েই আসলে আমাদের উৎসাই নাই। আমরা স্কুলে আসি, স্যার ম্যাডামদের বকাবকিইনি, পিটুনি খাই তারপর বাসায় চলে যাই। স্কুলের এসেম্বলী হয় না, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না তাই যে সব স্যার ম্যাডাম আমাদের ক্লাশে আসেন না আমরা তাদেরকে চিনিও না।
মিঠুনের উৎসাহের জন্যে শেষ পর্যন্ত একটা দরখাস্ত লিখে আমরা কয়েকজন হেড স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম, যেতে যেতে আমাদের দলটা বেশ ভারী হয়ে গেল। মিঠুনের সাথে আমি, বগা, ঝুম্পা, ফারা তো আছিই, গুললু এমন কী রোল নম্বর তেতাল্লিশ পর্যন্ত আমাদের পিছু পিছু রওনা দিল।
আমরা আবিষ্কার করলাম স্কুলের একটা অফিস আছে আর সেই অফিসের পাশে হেড মাস্টারের রুম। দরজায় ভারী পর্দা তাই ভেতরে কেউ আছে কী না বোঝা গেল না। মিঠুন তাই আমাদেরকে নিয়ে প্রথমে অফিসে হাজির হল। সেখানে শেয়ালের মত দেখতে একজন মানুষ টেবিলে ঝুঁকে এক কপি দৈনিক মহব্বত পড়ছে। আরেক পাশে একজন চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমাদের স্যার ম্যাভামরা যেরকম কোনো কাজ কর্ম করেন না, অফিসের লোকজনেরাও সেরকম কোনো কাজকর্ম করে না।
আমাদের দেখে শেয়ালের মত মানুষটা বলল, “কী ব্যাপার?”
মিঠুন বলল, “আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলায় আমাদের স্কুল থেকে টিম পাঠানোর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
মানুষটা বলল, “অ।” তারপর আবার দৈনিক মহব্বত পড়তে শুরু করল। যে মানুষটা ঘুমাচ্ছিল সে হঠাৎ জেগে উঠল, চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে? এ্যাঁ? কী হয়েছে?”
ঝুম্পা বলল, “আমরা হেড স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
শেয়ালের মত মানুষটা দৈনিক মহব্বত থেকে চোখ না তুলে বলল, “দেখা হবে না। যাও।”
ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষটা বলল, “কেন? কেন দেখা করতে চাও? কী হয়েছে? হ্যা? কী হয়েছে?”
ঝুম্পা বলল, “আয় যাই। এইখানে কথা বলে লাভ নাই।”
তাই আমরা অফিস থেকে বের হয়ে সরাসরি হেড স্যারের রুমের সামনে দাঁড়ালাম। মিঠুন পর্দা সরিয়ে বলল, “স্যার, আসতে পারি?”
আমরা সবাই তখন হেড স্যারকে দেখলাম, বড় একটা টেবিলের সামনে বসে দৈনিক মহব্বত পড়ছেন। হেড স্যারকে দেখে আমরা সবাই বুঝতে পারলাম এই মানুষটাকে আমরা আগেও দেখেছি। মানুষটা যে হেড মাস্টার বুঝতে পারি নাই, ভেবেছি দপ্তরী না হয় কেরানী।
হেড স্যার চোখ পাকিয়ে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে?”
“আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আসব স্যার?”
আমি নিশ্চিত ছিলাম হেড স্যার ধমক দিয়ে বের করে দিবে। কিন্তু মিঠুনের চোখে চশমা, কথা বলার স্টাইল এগুলো দেখে মনে হয় হেড স্যার
একটু অবাক হলেন, বললেন, “আয়।”
মিঠুনের পিছু পিছু আমরা সবাই ঢুকে গেলাম, হেড স্যার তখন একটু চমকে উঠলেন, আমরা এতোজন ঢুকে যাব বুঝতে পারেননি। আঁতকে উঠে বললেন, ‘এঁ! এতোজন? এতোজন আসার দরকার কী?”
মিঠুন বলল, “স্যার। আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা হচ্ছে, আমরা সেই মেলায় যোগ দিতে চাই।”
হেড স্যার মিঠুনের কথা শুনে খুবই অবাক হলেন, কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “কিসের জন্য? হেইখানে গিয়া মাইরপিট করবি?”
মিঠুন বলল, “না স্যার। আমরা সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে যাব।”
“প্রজেক্ট পাইবি কই? বাজারে কিনতে পাওয়া যায়?”
না স্যার। আমরা প্রজেক্ট তৈরি করব।”
“তোরা প্রজেক্ট তৈরি করবি? আমারে সেই কথাটা বিশ্বাস করতে কইতাছস?
“জী স্যার। আমরা ল্যাবরেটরি ঘরটা ঠিক করেছি। সেখানে প্রজেক্ট তৈরি হবে।”
“এই স্কুলে কারা পড়ে তুই জানস? এই স্কুলে পড়ে শহরের যত চোর ডাকাইত গুণ্ডা বদমাইসের পোলাপান। এই পোলাপান বড় হইয়া কী হইব জানস? তারাও বড় হইয়া হইব চোর ডাকাইত গুণ্ডা বদমাইস। তাই আমার লগে মশকরা করনের দরকার নাই। বিজ্ঞান মেলায় যাওনের কথা বলার দরকার নাই। চুরি ডাকাতি গুণ্ডা বদমাইসী করনের মেলা থাকলে খবর নিস কয়েক হালি টিম পাঠামু।”
মিঠুন শেষ চেষ্টা করল, বলল, “স্যার আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমরা সবকিছু করব। আমরা একটা দরখাস্ত লিখে এনেছি, আপনি শুধু একটা সাইন দিয়ে দিবেন তাহলেই আমাদের টিমকে জায়গা দিবে। আমরা সব কিছু করব। খালি একটা সাইন।”।
হেড স্যার খেকিয়ে উঠলেন, “যা! ভাগ।”
“একটা খালি সিগনেচার সার।”
“দূর হ এইখান থেকে। পাজী বদমাইস বেআদপ বেআক্কেল বেতমিজ।” এক নিঃশ্বাসে বে দিয়ে শুরু এতোগুলো শব্দ বলা যেতে পারে আমরা কখনো চিন্তা করি নাই।
মিঠুন প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল, “আমাদের খুব শখ ছিল স্যার। আপনি শুধু একটা সাইন দিবেন স্যার। প্লীজ স্যার।”