মিঠুন ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা রাখা বাক্সটা নিয়ে সাবধানে সেটা খুলল, ভেতরে জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে, একদিকে পুড়ে একটা বড় গর্ত পর্যন্ত হয়ে গেছে। মিঠুন সাবধানে শিশিটা বের করে একবার নেড়ে দেখল, ভেতরে কিছু দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় শিশিটাতে কিছু একটা আছে।
মিঠুন শিশিটার দুই পাশে দুই টুকরা রাংতা ল্যাপ্টে লাগিয়ে নেয়। তারপর টেবিল ল্যাম্প থেকে দুই টুকরা তার ছিড়ে নিয়ে উপরের প্লাস্টিক সরিয়ে ভেতরের তার বের করে নেয়। দুইটা তার শিশির দুই পাশের রাংতার সাথে প্যাচিয়ে নিয়ে সে শিশিটা মেঝেতে রাখল। তারপর আমাকে বলল, রিমোটের ব্যাটারিগুলো বের করতে। আমি ব্যাটারি দুটো বের করার পর মিঠুন সাবধানে তারের দুই মাথা ব্যাটারির দুই পাশে লাগাতেই তুলকালাম একটা কাণ্ড ঘটল। শিশিটার ছিপিটা গুলির মতো উপরে ছুটে গেল আর শিশির ভেতর থেকে জ্বলন্ত নীলাভ আলোয় একটা শিখার মতো লকলকে কিছু একটা বের হয়ে ছাদে আঘাত করল। পুরো ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে আমরা রেডি হবার সময় পর্যন্ত পেলাম না কোনোমতে তার ব্যাটারি খুলে ছিটকে সরে গেলাম। কানেকশন ছুটে যেতেই সেই লকলকে শিখাটা সুড়ৎ করে শিশির ভেতরে ঢুকে গেল।
মিঠুনের চোখ চকচক করতে থাকে। কোনোমতে নিশ্বাস আটকে বলল, “প্লাজমা!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “প্লাজমা কী?”
“ কোনো গ্যাস যখন আয়োনাইজ হয়, সেটাকে বলে পাজমা।”
“আয়োনাইজ মানে কী?”
“গ্যাসের ইলেকট্রনকে যখন ছুটিয়ে নেয় তখন বলে আয়োনাইজ হওয়া।
“ইলেকট্রন কেন ছুটে যাচ্ছে?”
“কোনো এক ধরনের শক্তি বের হচ্ছে সেই শক্তি ছুটিয়ে দিচ্ছে।”
মিঠুন জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “সাধারণত লো প্রেসারে জমা তৈরী হয়। এখানে গ্যাসের স্বাভাবিক চাপেই হয়ে যাচ্ছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে কী?”
“তার মানে প্রচণ্ড এনার্জি বের হচ্ছে।”
“সেটা ভালো না খারাপ?”
“সেটা ফ্যান্টাস্টিক।” মিঠুন চোখ বড় বড় করে বলল, “সেটা অসাধারণ।”
ব্যাটারি লাগালে কী হতে পারে সেটা যেহেতু জেনে গেছি তাই এর পরে আরেকটু সাবধানে কানেকশন দেয়া হলো, আবার শিশির ভেতর থেকে জীবন্ত প্রাণীর মত লকলকে প্লাজমা ভয়ঙ্কর শব্দ করে বের হয়ে আসে, সারা ঘরে ওষুধের মতো একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। প্লাজমাটা ছাদে যেখানে গিয়ে ধাক্কা খেল সেখান থেকে প্যালেস্তারা খসে পড়ল। মিঠুন সেটা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
কয়েকবার এক্সপেরিমেন্ট করে মিঠুন সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল। তারপর শিশিটা আবার বন্ধ করে বাক্স রেখে দেয়। বাক্সে রাখার আশা এবার সে রাংতা দিয়ে ভালো করে মুড়ে নেয় তাহলে লাল ইলেকট্রিক ফিল্ড ঢুকতে পারবে না। আশপাশে বাজ পড়লেও সমস্যা নেই।
০৬. স্কুল ছুটির পর আমরা বাসায় যাচ্ছি
স্কুল ছুটির পর আমরা বাসায় যাচ্ছি, কোর্টের কাছাকাছি কিছু একটা দেখে মিঠুন দাঁড়িয়ে গেল। আমরাও দাড়িয়ে গেলাম। কোর্টে দেওয়ালে একটা পোস্টার, পোস্টারে বড় বড় করে লেখা, আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা। নিচে লেখা আমাদের ছোট শহরের সব স্কুল কলেজ মিলে একটা আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তিনদিন ধরে এই মেলা চলবে, শেষ দিনে পুরস্কার দেয়া হবে।
মিঠুন বলল, “আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা, আমরা সেখানে যোগ দিচ্ছি না কেন?”
“বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিব? আমরা?” বলে ঝুম্পা হি হি করে হাসতে লাগল। জিনিষটা এতোই হাস্যকর যে আমরাও হি হি করে হাসতে লাগলাম।
মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “এর মাঝে হাসির কী আছে? গত বছর বিজ্ঞান বেলায় আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম।”
আমি বললাম, “গত বছর তুই ছিলি অকুব্রীজ স্কুলে। এই বহুর তুই মহব্বতজান স্কুলে। মহব্বতজান স্কুল থেকে কেউ কোনোদিন বিজ্ঞান মেলায় যোগ দেয় নাই।”
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, “এটা হতেই পারে না যে আমরা বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিব না। আমাদেরকে জানানো হল না কেন? আমাদের স্কুলে চিঠি পাঠানো হল না কেন?”
ঝুম্পা হি হি করে হেসে বলল, “নিশ্চয়ই চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠি কেউ কোনোদিন খুলে দেখে নাই। সোজাসুজি ছিড়ে ফেলে দিয়েছে।”
আমি বললাম, “ভালই হয়েছে ছিড়ে ফেলে দিয়েছে, চিঠি খুললে এর ভিতরে কী লেখা আছে কেউ কোনোদিন বুঝতে পারত না। এই স্কুলের কেউ বিজ্ঞান বানান পর্যন্ত করতে পারে না।”
মিঠুন বলল, “আমি এখনই খোঁজ নিব বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিতে হলে কী করতে হয়। তারপর কাল স্যারদেরকে বলব।”
বগা বলল, “তোর ইচ্ছা হলে বল, আমি আগে থেকে তোকে বলে দিতে পারি বলে কোনো লাভ হবে না। ক্ষতি হতে পারে।”
“ক্ষতি? কী ক্ষতি হবে?”
“এটা বলার জন্যে তোকে আচ্ছামতন বানাতে পারে। স্যারেরা তোকে সাইজ করে ছেড়ে দিতে পারে।”
“সাইজ করলে করবে। আমি স্যারকে বলব।”
পরের দিন ক্লাশে বিজ্ঞান স্যার আসতেই মিঠুন দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “স্যার।”
কালাপাহাড় স্যার খুব অবাক হলেন। এই স্কুলে নিজে থেকে কোন ছাত্র-ছাত্রী, স্যারদের কিছু বলে না, স্যারেরা কিছু বললে তার উত্তর দেয়। কালাপাহাড় স্যার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল?”
“আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা পরশু দিন থেকে। আমাদের স্কুল থেকে আমরা যোগ দিতে চাই।”
“কীসে যোগ দিতে চাস?”
“বিজ্ঞান মেলা। সায়েন্স ফেয়ারে স্যার।” কালাপাহাড় স্যারের ভুরু আরো বেশী কুঁচকে গেল, “সেটা আবার কী?”