মিঠুন শুকনো মুখে বলল, “স্যার আলাদা করে ফেলে দেখাতে হলে একটা পাম্প লাগবে স্যার।”
“এখন লাট সাহেবের জন্যে পাম্প কিনতে হবে? আর কী কিনতে হবে? রকেট ইঞ্জিন?”
মিঠুন বলল, “স্যার আপনাকে একটা জিনিষ জিজ্ঞেস করব স্যার?”
“আমাকে?”
“জী স্যার।”
কালাপাহাড় স্যার সন্দেহের চোখে মিঠুনের দিকে তাকালেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছে। জিজ্ঞেস কর।”
“স্যার আপনি বলেছেন একটা হালকা জিনিষ আস্তে পড়ে?”
“অবশ্যই আস্তে পড়ে। সবাই জানে।”
“তাহলে একটা ভারী জিনিষকে যদি আস্তে ফেলতে চাই তাহলে তার সাথে কয়েকটা হালকা জিনিষ বেঁধে দিতে পারব স্যার। হালকাগুলো আস্তে পড়বে তাই ভারী জিনিষটা তাড়াতাড়ি পড়তে পারবে না।”
কালাপাহাড় স্যার কিছু একটা চিন্তা করলেন তারপর বললেন, “সেটাই তো হবে। এটা কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
মিঠুনের মুখে হঠাৎ একটা ফিচলে হাসি ফুটে উঠল, “কিন্তু স্যার ভারী জিনিষটার সাথে হালকা জিনিষগুলো বেঁধে দেয়ার জন্যে সব মিলিয়ে ওজন আগের থেকে বেশি হয়ে গেল না?”
“হয়েছে। তাতে সমস্যা কী?”
“আগের থেকে ভারী হবার কারণে এখন কী আগের থেকে তাড়াতাড়ি পড়বে না? ভারী জিনিষ তো তাড়াতাড়ি পড়ে।“
কালাপাহাড় স্যারকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল। বললেন, “কী বললি?”
“বলেছি ভারী জিনিষটাকে আস্তে ফেলার জন্যে তার সাথে হালকা জিনিষ বেঁধেছি–কিন্তু এখন পড়ছে তাড়াতাড়ি—”
কালাপাহাড় স্যারের মুখ থমথম করতে লাগল, হুংকার দিয়ে বললেন, “তুই কী বলতে চাস?”
মিঠুন বলল, “আমি কিছু বলতে চাই না শুধু জিজ্ঞেস করছি। এক ভাবে চিন্তা করলে আস্তে পড়বে, অন্যভাবে চিন্তা করলে তাড়াতাড়ি পড়বে, কোনটা সত্যি? দুইটাই তো সত্যি হতে পারে না। এটাকে সমাধান করার একটা মাত্র উপায়। সেটা হচ্ছে যদি আমরা মেনে নেই ভারী আর হালকা জিনিষ যদি এক সাথে পড়ে। তার মানে স্যার কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার দরকার নাই শুধু যুক্তি দিয়ে দেখানো যায় ভারী আর হালকা জিনিষ এক সাথে নিচে পড়ে।”
কালাপাহাড় স্যারকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাল, খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এটা তোর যুক্তি হল? এটা হচ্ছে কুযুক্তি। যতো রকম কুযুক্তি। বদযুক্তি।”
আমরা বুঝতে পারলাম মিঠুন শেষ পর্যন্ত স্যারকে যুক্তি দিয়ে আটকে ফেলেছে। মিঠুন মিন মিন করে বলল, “না স্যার এইটা কুযুক্তি না। এইটা আমি এক বইয়ে পড়েছি।”
“যত্তোসব। আউটবই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ঐগুলো পড়ে ব্রেন নষ্ট।”
বলে স্যার আপ থপ করে, বের হয়ে গেলেন। অমর চাপা গলায় আনন্দের মত শব্দ করলাম।
মিঠুন বলল, “যাক বাবা বাঁচা গেল।”
আমি বললাম, “আরেকটু হলে কিলিয়ে স্যার তোকেই ব্ল্যাক হোল বানিয়ে দিত।”
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, “কিলিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরী করা যায় না। ব্ল্যাক হোল তৈরী হওয়ার নিয়ম আছে। বৈজ্ঞানিক জিনিষ নিয়ে ভুল কথা বললে মিঠুন খুব বিরক্ত হয়।
আসল ব্ল্যাক হোল কী জিনিষ সেটা কেমন করে তৈরি করতে হয়, সেটা তৈরী হলে কী হয় আমি কিছুই জানি না কিন্তু মিঠুনের ব্ল্যাক হোলের বাচ্চাটা কী করতে পারে সেটা আমি সেদিন সন্ধেবেলা টের পেলাম।
সারাটাদিন গুমোট গরম ছিল, সন্ধেবেলা আকাশ কালো করে মেঘ জমা হতে শুরু করল। মেঘ আমার খুব ভালো লাগে, আকাশে কতো রকম মেঘ থাকে ভালো করে লক্ষ্য না করলে কেউ সেটা দেখতেও পাবে না। আমি তাই মেঘ দেখার জন্যে বাসায় ছাদে উঠে গেলাম।
মনে হতে লাগল মেঘগুলো বুঝি জীবন্ত কোনো প্রাণী, আকাশের এক কোণা থেকে পাক খেয়ে খেয়ে আসতে থাকে, আসতে আসতে এটা পাল্টে যেতে থাকে, কখনো এক জায়গায় জড়ো হয় আবার কখনো ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে কালো মেঘের ভিতর বিদ্যুতের ঝলকানি হতে থাকে। মনে হয় দূরে কোথাও বুঝি মেঘের ভেতর আলো আটকে রেখেছে, মেঘটা টুকরো করে সেই আলো বের হয়ে আসবে। অনেক দূরে বিজলী চমকাতে থাকে আর একটু পর মেঘের গুড়গুড় শব্দ শুনতে পেলাম আমার এটা শুনতে কী যে ভালো লাগে!
আমি সার্টের বোতাম খুলে ছাদে হাঁটতে থাকি, যখন প্রথম বৃষ্টির ফোটা পড়বে সেই বৃষ্টিতে ভিজতে কী যে মজা সেটা যারা বৃষ্টিতে ভিজে শুধু তারাই জানে। আকাশে ঠিক আমার মাথার উপর বিজলী চমকাতে থাকে আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। ছাদে চিলেকোঠায় আমার যে ঘরটা আমি মিঠুনকে তার ল্যাবরেটরি তৈরী করতে দিয়েছি সেই ঘরটার ভিতরে খুট খুট করে একটা শব্দ হল। আমার মনে হল ঘরের ভেতরে কেউ একজন আছে, আমি চমকে উঠলাম আর ভয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠল।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি শুনতে ভুল করেছি, মেঘের সাথে স:থে একটু ঝড়ো বাতাস দিচ্ছে, এই বাতাসের জন্যে হয়তো দরজা কিংবা জানালা কেঁপে শব্দ হচ্ছে। একটু পর বুঝতে পারলাম আসলে এটা দরজা জানালার শব্দ না, ঘরের ভিতরে কিছু একটা নড়ছে। আমার ভয়টুকু বাড়তে লাগল, শুনতে পেলাম ভেতরে খট খট শব্দটাও আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা জীবন্ত প্রাণী ঘরের ভেতরে ছোটাছুটি করছে।
তখন হঠাৎ করে আরো বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করল। আমি দেখলাম দরজার নিচ দিয়ে নীল একটা আলো বের হতে শুরু করছে। খট খট শব্দের সাথে সাথে আলোটা বাড়ছে আর কমছে।
প্রথমে আমার ইচ্ছে হল এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যাই, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম তারপর অনেক সাহস করে আমি আস্তে আস্তে চিলেকোঠার ছিটকানী খুলে দরজাটা খুললাম, তখন ভেতরে যে দৃশ্যটি দেখলাম তাতে আমার হার্টফেল করার অবস্থা।