মিঠুন ছবিগুলো দেখে ভয় পেলো না, চমৎকৃত হল। বলল, “তুই খুব ভালো আঁকিস। তার থেকে ইম্পরট্যান্ট কী জানিস?”
“কী? “তোর আইডিয়াগুলো ভালো। এরকম আইডিয়া আমি দেখি নাই।” আমি বললাম, “তোকে এখানে এনেছি কেন জানিস?”
“কেন?”
“কেন?”
“এটা আমার ঘর। তোকে এই ঘরটা দেখাতে এনেছি।”
“দেখলাম।”
“এই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ আসে না।”
মিঠুন দেওয়ালের ছবিগুলো দেখিয়ে বলল, “কেউ আসলেও ভয়ে পালাবে।”
আমি বললাম, “তোর এই ঘরটা পছন্দ হয়?”
“হবে না কেন?”
“তোকে আমি এই ঘরটা দিয়ে দিলাম। তুই ইচ্ছা করলে এইখানে তোর ল্যাবরেটরি বানাতে পারিস।”
মিঠুন জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
“আমার ল্যাবরেটরি?”
“হ্যাঁ। তোর ল্যাবরেটরি।”
“কেউ কিছু বলবে না? টান দিয়ে যন্ত্রপাতি, ক্যামিকেল নালায় ফেলে দিবে না?”
মিঠুনের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মাথা নেড়ে বলল, “আমার নিজের ল্যাবরেটরি?”
“হ্যাঁ। তোর নিজের ল্যাবরেটরি।”
মিঠুনকে আমরা কয়েকদিন হল দেখছি, চোখে চশমা মাথায় এলোমেলো চুল গম্ভীর মুখ দেখে কেমন যেন বড় মানুষের মতো মনে হয়। আমাদের চিলেকোঠায় সে তার ল্যাবরেটরি বসাতে পারবে শুনে প্রথমবার তার মুখে সত্যিকারের একটা হাসি ফুটে উঠল আর তাকে একটা বাচ্চা ছেলের মতো দেখাতে লাগল : মিঠুন ঘরটার ভিতরে কয়েকবার হেঁটে তার পকেট থেকে শিশিটা বের করে বলল, “আমি তাহলে ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা এই খানে রেখে যাই?”
“রেখে যা।”
“কেউ নিবে না তো?”
“না কেউ নিবে না। এটা একটা নেওয়ার মত জিনিষ না।”
মিঠুন গম্ভীর মুখে বলল, “শিশিটা পড়ে ভেঙে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” বলে আমি আমার ছোট একটা বাক্স এনে শিশিটাকে কাপড়ে জড়িয়ে বাক্সের ভিতরে রেখে দিলাম, বললাম। এখন এটা পড়ে ভেঙ্গে যাবে না।”
পরদিন ক্লাশে বসে মিঠুন তার খাতায় আঁকিবুকি করতে করতে বিড় বিড় করে নিজের সাথে কথা বলতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ তোর কী হয়েছে? কার সাথে কথা বলছিস?”
মিঠুন বলল, “কারো সাথে না। ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা কীভাবে টেস্ট করব ঠিক করছি।”
“কীভাবে করবি?”
“জিনিষটার ভর বের করতে হবে। তাপমাত্রা, তাপ পরিবহন, রেজিস্ট্যান্স এগুলো সব বের করতে হবে। কেমন করে বের করা যায় তাই দেখছি।”
“কেমন করে বের করবি?”
“এখনো জানি না, কিছু যন্ত্রপাতি লাগবে।”
“যন্ত্রপাতি কোথায় পাবি?”
মিঠুন মাথা চুলকালো, “এখনো জানি না। কিনতে হবে।”
এটা ছিল বিজ্ঞান ক্লাশ আর এরকম সময় বিজ্ঞান স্যার ক্লাশে ঢুকলেন! স্যারের নাম আক্কাস আলী, আমরা ডাকি কালা পাহাড়–কারণ আক্কাস আলী কালো এবং পাহাড়ের মত বড়। স্যার ক্লাশে এসে সাধারণত একটু কষ্ট করে চেয়ারের দুই হাতলের ফাঁক দিয়ে নিজের শরীরটা ঢুকিয়ে বসে পড়েন। তারপর মুখ হা করে ঘুমিয়ে যান, বিচিত্র শব্দ করে তার নাক ডাকতে থাকে।
আজকে কী হল কে জানে কাল পাহাড় স্যার, একটা বেত নিয়ে ক্লাশে ঢুকলেন আর কষ্ট করে চেয়ারে ঢুকে না গিয়ে ক্লাশের সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম শব্দ করে হুংকার দিতে লাগলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “তোরা সবাই লেখা পড়া করিস তো?”
আমরা মাথা নাড়লাম। স্যার হাতের বেত দিয়ে টেবিলে চটাশ করে মেরে বললেন, “আর লেখাপড়া করবি কেমন করে? কী পড়বি? বইয়ের মাঝে সব ভুলভাল লেখা।”
বইয়ের মাঝে ভুলভাল কী লেখা আমার জানার ইচ্ছে করছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। তখন কালা পাহাড় স্যার নিজেই বললেন, “তোদের বইয়ে লেখা ভারী আর হালকা জিনিষ ছেড়ে দিলে নাকী দুইটা একসাথে নিচে পড়বে। এটা কখনো সম্ভব?”
আমরা চুপ করে রইলাম শুধু মিঠুন মিহি গলায় বলল, “সম্ভব।”
কপাল ভালো কালাপাহাড় স্যার মিঠুনের কথা শুনতে পেলেন না। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। স্যার বললেন, “ভারী জিনিষ আগে পড়ে হালকা জিনিষ পড়ে পরে। দুনিয়ার সবাই এই কথা জানে। আর বইয়ে পুরা উল্টা কথা লেখা। তাজ্জবের ব্যাপার।”
মিঠুন চিকন গলায় বলল, “একসাথে পড়ে।”
কালাপাহাড় স্যার এবার মিঠুনের কথা শুনে ফেললেন, চমকে উঠে বললেন, “কে? কে কথা বলে?”
মিঠুন বলল, “আমি স্যার।”
স্যার এবারে প্রথম মিঠুনকে দেখতে পেলেন, তারপর বাঘ যেভাবে হরিণকে ধরে কিংবা বিড়াল যেভাবে ইদুরকে ধরে কিংবা টিকটিকি যেভাবে পোকাকে ধরে ঠিক সেইভাবে মিঠুনের দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, “তুই কী বলেছিস?”
“আমি বলেছি ভারী জিনিষ আর হালকা জিনিষ এক সাথে পড়ে।”
স্যার শূন্যে শপাং করে বেতটা মেরে হুংকার দিলেন, “কোনদিন দেখেছিস একসাথে পড়তে?”
“বাতাসের বাধা—”
“ফালতু কথা। বাতাসের আবার বাধা কী?” স্যার হুংকার দিলেন, “বেরিয়ে আয় আজকে তোকে বেতিয়ে সিধে করে দেব। বাতাসের বাধা বের করে ছাড়ব।”
মিঠুন কোনো কথা বলল না, কাঠ হয়ে বসে রইল।
“বের হয়ে আয় বলছি, আজ তোকে দেখাচ্ছি মজা।”
মিঠুন ঢোক গিলে আমার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “মারবে নাকী আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“ব্যথা লাগবে?”
“হ্যাঁ।” “বেশী?”
“শরীরটা শক্ত করে রাখিস না। ঢিলে ঢালা করে রাখিস তাহলে ব্যথা একটু কম লাগবে।”
কালাপাহাড় স্যার আবার হুংকার দিলেন, “বের হয়ে আয়।”
মিঠুন বের হয়ে এগিয়ে গেল, স্যার মিঠুনকে মারার আগে বেতটা বাতাসে শপাং করে মেরে একবার প্র্যাকটিস করে নিলেন, তারপর দাঁত মুখ খিচিয়ে এগিয়ে গেলেন, মিঠুন দুই হাত উপরে তুলে বলল, “স্যার, স্যার একটা কথা।”