মিঠুনের সায়েন্স স্যার অবাক হয়ে ঝুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সাক্ষী রেখে কথা বলবে?”
“হ্যাঁ। এখন থেকে মিঠুন আর একা একা কারো সাথে কথা বলবে না।”
মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “জী স্যার। এরা সবাই আমার বন্ধু। আপনি এদের সামনে কথা বলতে পারেন।”
সায়েন্স স্যার বললেন, “কিন্তু কথাগুলো খুব সেনসিটিভ।”।
মিঠুন বলল, “সমস্যা নাই। আমার এই বন্ধুরাও খুব সেনসিটিভ ”
আমরা জোরে জোরে মাথা নাড়লাম আর সায়েন্স স্যার কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে, আমি আমাদের স্কুলের সেই এক্সপ্লেশনটার ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
“বলেন।”
“স্কুলটা খোলার জন্যে ডিসিশন নেয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে না। বলছে-” স্যার থেমে গিয়ে এদিক সেদিক তাকালেন।
“কী বলছে?”
“মানে ইয়ে একপ্লোশনে যে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করা হয়েছে সেটার মাঝে ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টদের এক্সপ্লেসিভের একটা মিল আছে। তারা সন্দেহ করছে–”
“কী সন্দেহ করছে?”
“না মানে ইয়ে বলছিলাম কী—” সায়েন্স স্যার ইতস্তত করে বললেন, “আমরা সবকিছু বলেছি, কিন্তু পুলিশ বিশ্বাস করতে চাইছে না। বলছে ক্লাশ এইটে পড়ে একটা ছেলের পক্ষে এটা করা সম্ভব না। নিশ্চয়ই কোনো বড় মানুষ আছে।”
ঝুম্পা বলল, “মিঠুন তুই কোনো কথা বলবি না। খালি শুনে যা।”
আমরাও জোরে জোরে মাথা নাড়লাম, “শুনে যা। খালি শুনে যা।”
সায়েন্স স্যার মনে হয় আরো একটু ঘাবড়ে গেলেন, বললেন, “তুমি যদি পুলিশকে একটু বুঝিয়ে বল কেমন করে করেছ। বিশেষ করে কেন করেছ”।
ঝুম্পা আবার গম্ভীর গলায় বলল, “খবরদার মিঠুন, তুই একটা কথাও বলবি না। একটা কথাও না।”
স্যার বলল, “ঠিক আছে পুলিশকে বলতে হবে না। খালি আমাকে বল কেন করেছ। কী উদ্দেশ্য–আমি চিন্তা করে পাই না।”
ঝুম্পা বলল, “বলবি না।”
স্যার বলল, “আমি কথা দিচ্ছি কাউকে বলব না। কাউকে না।
ঝুম্পা বলল, “খবরদার মিঠুন তুই একটা কথা বলবি না। তুই এখন আর অক্সব্রীজ স্কুলে পড়িস না। এখন তুই আমাদের স্কুলে পড়িস। (ঝুম্পা আমাদের কথাটা বলার সময় বুকে একটা থাবা দিল) তোর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব এখন আমাদের (আবার বুকে থাবা। আমাদের পারমিশান ছাড়া তুই যদি একটা কথা বলিস অমর! তোর ঠ্যাঙ্গ ভেঙ্গে দিব (হাত মুঠি করে ঘুষি দেওয়ার ভঙ্গি)।”
মিঠুন তার সায়েন্স স্যারের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে একবার ঘাড় ঝাকুনী দিল। সায়েন্স স্যার তখন দাঁড়িয়ে পড়লেন, আমরা হেঁটে হেঁটে চলে এলাম।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাটতে একজন একজন করে সবাই নিজেদের বাসার দিকে চলে গেল, থেকে গেলাম শুধু আমি আর মিঠুন। আমি মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর বাসা কোথায়?”
“ঐ তো কাজী বাড়ীতে।”
“কাজী বাড়ী তো পিছনে ফেলে এলাম।”
“জানি। এতো তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কী করব তাই তোর সাথে একটু হাঁটি।”
“আমার বাসায় যাবি?”
“বাসার লোকজন বিরক্ত হবে না তো? বড় মানুষেরা ছোটদের দেখলে খুব বিরক্ত হয়।”
“না হবে না। আমার বাসায় কোনো লোক টোক নাই।”
“কোনো লোক নাই?”
“না। খালি আমার বাবা আর আমি।”
“তোর মা?”
“মরে টরে গেছে মনে হয়। বাবা কিছু বলে না, আমিও কিছু জিজ্ঞেস করি না।”
কথাটা সত্যি না। আসলে আমি যখন ছোট তখন আমার মা বাবাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে গেছে। সেই কথাটা বলতে লজ্জা করে দেখে কাউকে বলি না।
মিঠুন তার ঠোঁট সূঁচালো করে শীষ দেওয়ার চেষ্টা করল, শীষের শব্দ হয়ে বাতাস বের হওয়ার একটা শব্দ হল। বলল, “তোর বাবা কী করে?”
“কিছু করে টিরে না।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তোদের চলে কেমন করে?”
“চলে টলে না।”
মিঠুন খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হি হি করে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল, “তোর কী মজা।”
মিঠুনের এই কথাটা অবশ্যি সত্যি। আমার বয়সী অন্য যে কোনো ছেলের থেকে আমার জীবন বেশী মজার। বাবা একটু আধপাগলা ধরণের মানুষ, আমার মনে হয় মা সেজন্যেই বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। শহরে আমাদের একটা দোতলা বাসা আছে নিচের তলাটা ভাড়া দেওয়া আছে, দোতালায় আমরা থাকি। ভাড়ার টাকা দিয়ে আমাদের টেনে টুনে দিন চলে যায়। মাঝে মাঝে বাবা টাকা কামাই করার জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা করে, তখন টাকা পয়সা নষ্ট হয়, টাকা পয়সার টানাটানি হয়। বাবা আমাকে কিছুই বলে না আমি যেটা ইচ্ছা হয় করি। আমিও বাবাকে কিছু বলি না বাবার যেটা ইচ্ছা হয় করে।
মিঠুনকে নিয়ে দোতালায় এসে দেখলাম দরজা খোলা, তার মানে বাবা বাসায়।
বাবা বাইরের ঘরে সোফায় আধাশোয়া হয়ে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখছিল। আমাকে দেখে বলল, “দশ বলে ষোল রান দরকার, হেরে যাবে মনে হয়।”
কার সাথে কার খেলা, দশ বলে ষোল রান না হলে কেন হেরে যাবে আমি বুঝতে পারলাম না বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আমার সাথে যে মিঠুন একটা নূতন ছেলে এসেছে মনে হয় বাবা সেটা লক্ষও করেনি। আমি বললাম, “বাবা এই যে মিঠুন। আমাদের ক্লাশে পড়ে।
বাবা টেলিভিশন থেকে চোখ না তুলে বলল, “নো বল হয়েছে। দশ বলে, পনেরো রান।”
আমি মিঠুনকে বললাম, “আয় উপরে যাই।”
মিঠুন বলল, “চল।”
আমাদের বাসার মাঝে ছাদটা একটু খোলামেলা, আমার কিছু করার না থাকলে ছাদে এসে শুয়ে থাকি। দিনের বেলা মেঘ আর রাত্রে তারা দেখি। ছাদে একটা চিলেকোঠা আছে, এই ঘরটা আমার নিজস্ব। মেঝেতে একটা মাদুর বিছানো আছে। পাশে একটা পুরানো শেলফে কিছু গল্পের বই। দেওয়ালে ছবি, রং দিয়ে সরাসরি দেওয়ালে আঁকা হয়েছে। ঘরটি আমার নিজস্ব— তাই বাইরের কেউ আসে না, এলে দেওয়ালের ছবি দেখে নিশ্চয়ই ভয় পেতো। প্রথম ছবিটি একজন মানুষের, সে বুক কেটে তার হৃৎপিণ্ডটি টেনে বের করে আনছে, মানুষটার মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন, হাতে পায়ে রক্ত। দ্বিতীয় ছবিটা একটা পিশাচের, থমথমে মুখ শুধু চোখ দুটি ভয়ংকর। ঠোটের পাশ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তৃতীয় ছবিটা একজন মানুষের, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, জিবটা বের হয়ে আছে।