তুমিই বলো। এসব ব্যাপার তুমিই ভালো বোঝ।
সত্যি কথাটি বলে দিলেই হয়।
কোনো সমস্যা হবে না তো?
নজীবউল্লাহ মুখ বাঁকা করে বলল, সমস্যা হতে বাকি রইল কী?
তা ঠিক। শরীফ আকন্দ কপাল মুছে বলল, তুমি তাহলে কিছু–একটা বলো।
নজীবউল্লাহ এক পা এগিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, তোমাদের সম্পর্কে কিছু তথ্য তোমাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছে তার কারণ তোমরা মানুষ থেকে ভিন্ন। একজন মানুষের যে–তথ্য জানার অধিকার আছে তোমাদের সেই অধিকার নেই।
কেন?
কারণ জীববিজ্ঞানের ভাষায় তোমরা পরিপূর্ণ মানুষ নও। তোমাদের শরীরে দুটো ক্রমোজম কম। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তোমাদেরকে প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র একটা মস্তিষ্ক হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই মস্তিষ্ককে কাজ করার জন্যে যেসব দরকার শুধুমাত্র সেসব রাখা হয়েছে–তার বাইরে কিছু নেই। তোমরা মানুষের মতো জন্ম নাও না। তোমাদেরকে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে ক্লোন করা হয়। তোমাদের মস্তিষ্কের নিউরনকে সবসময় অতি উত্তেজিত অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। কাজেই তোমাদের বয়স দশ থেকে এগার হওয়ার মাঝেই তোমরা অকর্মণ্য হয়ে পড়।
তার মানে আমরা মানুষ নই?
না। মানুষের অনুভূতিও তোমাদের নেই। তোমাদের রাগ দুঃখ অপমান বা আনন্দের অনুভূতি অত্যন্ত দুর্বল–না–থাকার মতোই। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তোমাদের নিউরনের সংখ্যা এবং সিনান্সের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়াও তোমাদের একসাথে এক পরিবেশে ক্লোন করা হয়েছে। তোমাদের মস্তিষ্কে বিশেষ ইলেকট্রড বসিয়ে তোমাদের বারোজনকে একসাথে অনুরণিত করা হয়–তোমাদের নিজস্ব বা ব্যক্তিগত অস্তিত্ব নেই। তোমরা সব সময়েই সমষ্টিগত প্রাণী। মানুষ থেকে ভিন্ন প্রাণী। মানুষের জন্যে এই পৃথিবীতে যে আইনকানুন বা অধিকার আছে সেই আইনকানুন বা অধিকার তোমাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। তোমরা নিজেরাই জান তোমরা দেখতেও মানুষের মতো নও।
বুঝতে পেরেছি। বিকলাঙ্গ শিশুগুলো খনখনে গলায় বলল, আমরা জৈবিক প্রাণী হলেও বিবর্তনের মূলধারায় আমরা নেই। আমাদের বিবর্তন হয় না।
তোমাদের বিবর্তন করা হয় ল্যাবরেটরিতে, বিজ্ঞানীরা করেন। তার নাম জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।
বিকলাঙ্গ শিশুগুলো কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর নিজেদের ভিতরে নিচুস্বরে নিজস্ব ভাষায় কথা বলল, তারপর আবার ওকে দিকে ঘুরে তাকাল।
নজীবউল্লাহ বলল, আমি কি তোমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি?
তোমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব দিয়েছ। বাকি উত্তর আমাদের নিজেদের খুঁজে নিতে হবে।
সেগুলো কী?
মানুষের দেহ আমাদের দেহ থেকে কোনভাবে ভিন্ন। তাদের ভেতরে বাড়তি কী অঙ্গ রয়েছে। তাদের মস্তিষ্কের গঠন কী রকম। জননেন্দ্রিয় কীভাবে কাজ করে।
নজীবউল্লাহ চমকে উঠল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, তোমরা সেটা কীভাবে জানতে চাও?।
বারোটি বিকলাঙ্গ শিশু তাদের হাত একসাথে উঁচু করল, নজীবউল্লাহ এবং শরীফ আকন্দ দেখল সেখানে একটি করে সার্জিক্যাল চাকু–কখন তারা হাতে নিয়েছে জানতেও পারে নি।
শরীফ আকন্দ কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর চিৎকার করে বলল, না। না–তোমরা এটা করতে পার না।
বিকলাঙ্গ শিশুগুলো বলল, পারি। তোমরা নিজেরাই বলেছ আমরা মানুষ নই। মানুষের জন্যে যে আইনকানুন প্রযোজ্য আমাদের বেলায় সেই আইন প্রযোজ্য নয়।
নজীবউল্লাহ এবং শরীফ আকন্দ অকল্পনীয় একধরনের আতঙ্কে দেখল বারোটি বিকলাঙ্গ শিশু হাতে ধারালো চাকু নিয়ে তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের কোনো অনুভূতি নেই, তাদের মুখে হাসি থাকার কথা নয় তবুও নজীবউল্লাহ এবং শরীফ আকন্দের স্পষ্ট মনে হল এই শিশুগুলোর মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।
নিশির জন্যে ভালবাসা
বাল্টিমোরের কনভেনশন সেন্টারে এইমাত্র আলবার্তো গার্সিয়া তার পেপারটি উপস্থাপন শেষ করেছেন। ওভারহেড প্রজেক্টরের সুইচটি অফ বর তিনি হলভর্তি দর্শকদের দিকে তাকালেন। বিজ্ঞানীদের কনফারেন্সে বক্তব্য শেষ হবার পর সাধারণত ছোট একটি সৌজন্যমূলক করতালি দেওয়া হয় কিন্তু এবারে একটি বিস্ময়কর নীরবতা বিরাজ করল। এই সেশনটির সভাপতি সেন্ট জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃদ্ধ অধ্যাপক বব রিকার্ডো প্রথমে করতালি দিতে শুরু করলেন এবং গ্যালারির প্রায় দুই হাজার শ্রোতা হঠাৎ করে চেতনা ফিরে পেয়ে করতালিতে যোগ দিল। দেখতে দেখতে করতালির প্রচণ্ড শব্দে হলঘরটি ফেটে যাবার উপক্রম হল কিন্তু তবুও সেটি থেমে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, বরং একজন–দুজন করে সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে উরুগুয়ের একটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত বিজ্ঞানীকে সম্মান দেখাতে শুরু করলেন। বিজ্ঞানীদের কনফারেন্সে সাধারণত সাংবাদিকরা থাকেন না কিন্তু জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের এই বার্ষিক কনফারেন্সে আলবার্তো গার্সিয়া যে পেপারটি। উপস্থাপন করবেন তার কথা কীভাবে কীভাবে জানি বাইরে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল, কাজেই আজ এখানে হলভর্তি সাংবাদিক। ফটো তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলতে শুরু করল। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্যে শ্রোতাদের অনেকে তাদের ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করলেন।