নজীবউল্লাহ আবার পকেট থেকে একটা ছোট কার্ড বের করে কিছু সংখ্যা উচ্চারণ করল।
বিকলাঙ্গ শিশুগুলোর ভেতর থেকে কোন একজন বলল, সমস্যা বাতিল করা হল।
নজীবউল্লাহ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বিকলাঙ্গ শিশুগুলো আবার নিজেদের টেনেহিঁচড়ে ঘরের নানা জায়গায় বসানো কম্পিউটারগুলোর সামনে বসে কাজ শুরু করে দেয়। তাদের কাজ করার দৃশ্যটি অদ্ভুত– অনেকটা পরাবাস্তব দৃশ্যের মতো মনে হয় কোনো পচে যাওয়া মাংসের টুকরোর মাঝে কিছু পোকা কিলবিল করছে। এই শিশুগুলো কৃত্রিম উপায়ে তৈরি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান শিল্প ক্লোন, ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস হয় না।
শরীফ আকন্দ নজীবউল্লাহর কনুই স্পর্শ করে বলল, চল যাই।
চল।
দুজন ঘরের দরজার দিকে হেঁটে যায়, হ্যান্ডেল স্পর্শ করে দরজা খোলার চেষ্টা করে আবিষ্কার করল দরজাটি বন্ধ।
সে কী! দরজা বন্ধ হল কেমন করে?
শরীফ আকন্দ এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল, সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ। বিকলাঙ্গ বারোজন শিশুর সাথে একটা ঘরে আটকা পড়ে গেছে–এই ধরনের একটি অবাস্তব আতঙ্ক হঠাৎ তাকে গ্রাস করে ফেলে।
শরীফ আকন্দ হ্যান্ডেলটি ধরে জোরে কয়েকবার টান দিল, কোনো লাভ হল না। নজীবউল্লাহ গলা নামিয়ে বলল, টানাটানি করে লাভ নেই। তুমি খুব ভালো করে জান এই দরজা বন্ধ হলে ডিনামাইট দিয়েও ভোলা যাবে না। সিকিউরিটিকে ডাক।
শরীফ আকন্দ আড়চোখে বারোজন বিকলাঙ্গ শিশুর দিকে তাকাল–তারা তাদের
দুজনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে–কী কুৎসিত একটি দৃশ্য! তার সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসে। শরীফ পকেট থেকে ছোট টেলিফোন বের করে সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ করার জন্যে লাল বোতামটি স্পর্শ করল। টেলিফোনে সবুজ বাতি না জ্বলে উঠে সেটি আশ্চর্যরকম নীরব হয়ে রইল। শরীফ আকন্দ টেলিফোনটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে নজীবউল্লাহর দিকে তাকাল, শুকনো গলায় বলল, টেলিফোন
কাজ করছে না।
নজীবউল্লাহ নিজের টেলিফোনটা দিয়ে চেষ্টা করে দেখল তার টেলিফোনটাও বিকল হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
এখন কী করা যায়?
নজীবউল্লাহ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি এত ভয় পেয়ে যাচ্ছ কেন?
না মানে–ইয়ে–তোমাকে তো বলেছি এদের দেখলেই আমার কেমন জানি লাগে।
কেমন লাগলে হবে না। এখন এদেরকেই বলতে হবে সিকিউরিটিকে জানাতে।
নজীবউল্লাহ আবার বিকলাঙ্গ শিশুগুলোর দিকে এগিয়ে গেল, একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছানোর পর শিশুগুলো নিজেদের কাজ বন্ধ করে সবাই একসাথে তাদের দিকে ঘুরে তাকাল।
কী ব্যাপার?
সিকিউরিটির সাথে যোগাযোগ করে তাদের বলতে হবে দরজাটা খুলে দিতে। দরজাটা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।।
দরজাটা কোনো কারণে বন্ধ হয় নি–দরজাটা আমরা বন্ধ করে রেখেছি।
শরীফ আকন্দ আর নজীবউল্লাহ এক সাথে চমকে উঠল, নজীবউল্লাহ হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠে বলল, তোমরা দরজাটা বন্ধ করে রেখেছ? তোমরা!
হ্যাঁ। আমরা।
দুজন দুজনের দিকে বিস্তারিতভাবে তাকাল, তারপর ঘুরে আবার বিকলাঙ্গ শিশুগুলোর দিকে তাকাল, তোমরা কীভাবে দরজা বন্ধ করলে?
মূল কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা অচল করে রেখেছি।
কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব?
সম্ভব। আমরা পারি।
অসম্ভব! এটি অসম্ভব।
না অসম্ভব নয়। আমরা বারোজন একসাথে অনুরণিত হই। আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা তিরিশগুণ বেশি। আমাদের সিন্সের সংখ্যা প্রতি নিউরনে এক হাজার গুণ বেশি। আমাদের যে–কোনো একজন তোমাদের একটি আলট্রা কম্পিউটার থেকে বেশি ক্ষমতাশালী।
নজীবউল্লাহ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমরা পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা অচল করে রেখেছ? এইজন্যে আমরা ফোন করতে পারছি না।
হ্যাঁ?
কেন?
তোমরা দুইজন বিশেষ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে আমাদের সম্পর্কে তথ্য আমাদের আওতার বাইরে রেখেছ। আমরা জানতে চাই কেন?
শরীফ আকন্দ অনুভব করল সে কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে। নজীবউল্লাহর কনুই খামচে ধরে বলল, এখন কী হবে?
নজীবউল্লাহ শরীফ আকন্দের হাত সরিয়ে বিকলাঙ্গ শিশুগুলোকে বলল, এর কারণটি খুব সহজ। তোমাদের ওপর নির্ভর করে ক্রন কম্পিউটিং গড়ে উঠেছে। কাজেই তোমাদের নিরাপত্তা আমাদের জন্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে–তথ্যে তোমাদের প্রয়োজন নেই সেই তথ্য তোমাদের দেওয়া হচ্ছে না।
কিন্তু তুমি যে–সমস্যাটি দিয়েছিলে সেটি সমাধান করার জন্যেই তো আমাদের সেই তথ্যটির প্রয়োজন হয়েছিল।
কিন্তু– নজীবউল্লাহ ইতস্তত করে থেমে গেল। এরা সাধারণ শিশু নয়, এরা সাধারণ মানুষও নয়, এদেরকে মিথ্যা কথা বলে বা কুযুক্তি দিয়ে থামানোর কোনো উপায় নেই। এদেরকে সত্যি কথা বলতে হবে–সে ঘুরে শরীফ আকন্দের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এরা অসম্ভব বুদ্ধিমান, তুমি আমি ওদেরকে মিথ্যা কথা বলে পার পাব না।
তাহলে?
নজীবউল্লাহ মাথা চুলকে বলল, হয় সত্যি কথা বলতে হবে না হয়
না হয়?
চুপচাপ বসে থাকি। সিকিউরিটির মানুষ টের পেয়ে যখন আমাদেরকে বের করবে।
কিন্তু সেটা তো কঠিন। এখানে বাইরের কোনো সাহায্য নেওয়া যাবে না। এই দরজা–তুমিই বললে ডিনামাইট দিয়েও ভাঙা যাবে না।
নজীবউল্লাহ মাথা চুলকে বলল, তাহলে কী করা যায় বলো দেখি?