ভেতরে বারোজন বিকলাঙ্গ শিশু। শরীরের তুলনায় তাদের মাথা অতিকায় এবং অপুষ্ট শরীরে এই বিশাল মাথা বহন করতে একধরনের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। তাদের লিকলিকে হাত পা, তবে হাতের আঙুলগুলো দীর্ঘদেখে মাকড়সার কথা মনে পড়ে যায়। কোটরাগত চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখের জায়গায় একধরনের গর্ত এবং সেখান থেকে লাল জিভ বের হয়ে আছে। নাক অপরিণত–দেখে মনে হয় কুষ্ঠরোগে বসে গিয়েছে। তাদের মাথার পিছন থেকে একধরনের কো–এক্সিয়াল কেবল বের হয়ে এসেছে, সেটি একটা ছোট যন্ত্রের সাথে যুক্ত। যন্ত্রটি তাদের মাথার পিছন থেকে ঝুলছে।
শিশুগুলো দরজায় শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল এবং শরীফ আকন্দ তখন আবার শিউরে উঠল প্রত্যেকটা শিশু হুবহু একই রকম। এদেরকে এক সাথে ক্লোন করা হয়েছে এবং একইভাবে বড় করা হয়েছে। সরাসরি মস্তিষ্কে ইলেকট্রড বসিয়ে মস্তিষ্কের একই জায়গা একই সময়ে স্পন্দিত করা হয়–কাজেই তারা একই সাথে অনুরণিত হয়। শিশুগুলোর বয়স ছয় বছর কিন্তু দেখে সেটা অনুমান করার উপায় নেই তাদেরকে মানুষ বলে মনে হয় না–কাজেই মানুষের বয়সের কোনো কাঠামোতে তাদেরকে ফেলা যায় না।
শরীফ আকন্দ বা নজীবউল্লাহ শিশুগুলোকে কোনোরকম সম্ভাষণ করল না–এদেরকে সামাজিক কোনো ব্যাপার শেখানো হয় নি নিজেদের কাজ শেষ করা ছাড়া আর কিছুই তারা জানে না। জীবউল্লাহ এক পা এগিয়ে এসে বলল, তেতাল্লিশ বি–এর সমাধান কি শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ। শেষ হয়েছে। নেটওয়ার্কে আপলোড করেছি।
চুহাত্তর এক্স টু?
কাজ করছি। ডাটা অনেক বেশি, নিউরন ওভারলোড হয়ে যায়।
কখন শেষ হবে?
দুই ঘণ্টা পর। দুই ঘণ্টা সাত মিনিট।
শরীফ আকন্দ একধরনের বিস্ময় নিয়ে এই বারোটি বিকলাঙ্গ শিল্প দিকে তাকিয়ে রইল। এরা বারোজন মিলে আসলে একটি প্রাণী। কথা বলার সময় কে বলছে বোঝা যায় না। একেকজন একেকটা শব্দ বলে বাক্য শেষ করে কিন্তু তার মাঝে বিন্দুমাত্র অসঙ্গতি নেই। ঠোঁট নেই–কাজেই ঠোঁট না নেড়ে সরাসরি ভোকাল কর্ড থেকে শব্দ বের করে কথা বলে, তাই একধরনের যান্ত্রিক উচ্চারণ হতে থাকে।
আমি তোমাদের জন্যে একটা নতুন সমস্যা এনেছি।
প্রায়োরিটি কত?
অন্য প্রায়োরিটি ওভার রাইড করতে হবে।
ওভার রাইড কোড কত?
নজীবউল্লাহ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কোডগুলো পড়ে শোনাল। এই শিশুগুলোকে অনেকটা যন্ত্রের মতো প্রস্তুত করা হয়ে হয়েছে। পদ্ধতির বাইরে এরা কাজ করতে পারে না। কোড শোনার পর শিশুগুলো তাদের বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে নিজের বিশাল মাথা নিয়ে প্রায় সারিবদ্ধ হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। নজীব সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, সমস্যাটি প্রচলিত ভাষায়। শব্দের অর্থ যথাযথ। রূপক উপসর্গ সর্বনিম্ন। বাক্যাংশ এরকম : ক্রন কম্পিউটিংয়ের ব্যবসায়িক সাফল্যের সম্ভাবনা কত?
নজীবের কথা শেষ হওয়া মাত্র শিশুগুলো নিজেদের কাছাকাছি চলে আসে, অপুষ্ট আঙুল নেড়ে নিজেদের ভিতরে দুর্বোধ্য একধরনের ভাষায় কথা বলে, একজন হামাগুড়ি দিয়ে একটা কম্পিউটারের সামনে উপুড় হয়ে বসে, দ্রুত হাত নেড়ে কিছু তথ্য প্রবেশ করায়। মাথা থেকে ঝুলে থাকা যন্ত্রগুলোতে আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে, একধরনের ভোঁতা যান্ত্রিক শব্দ হতে থাকে।
শিশুগুলোর অস্বাভাবিক কাজকর্ম যেরকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেরকম একেবারে হঠাৎ করে থেমে গেল। সবাই একসাথে মাথা ঘুরিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সমাধানে অনিশ্চয়তা নব্বই ভাগ।
কেন?
প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব।
মূল ডাটাবেস থেকে তথ্য নিয়ে নাও।
নিরাপত্তাজনিত কারণে তথ্যগুলো আমাদের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
শরীফ আকন্দ এবং নজীবউল্লাহ একজন আরেকজনের দিকে তাকাল–এ ব্যাপারটি ঘটতে পারে তারা আগে চিন্তা করে নি। শরীফ আকন্দ ইতস্তত করে বলল, যে তথ্যগুলো তোমাদের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে সেগুলো তোমাদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য। আমরা যে–প্রশ্নটি করেছি তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
আছে।
শরীফ আকন্দ ভাবল একবার জিজ্ঞেস করে কেন কিন্তু এই বিকলাঙ্গ শিশুগুলোকে যেভাবে বড় করা হয়েছে তাতে তাদের সাথে আলোচনা বা তর্ক–বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। নজীবউল্লাহ জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী জানতে চাও?
আমরা কারা? আমরা এখানে কেন?
নজীবউল্লাহ নিজের ভিতরে একধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে মানুষের যে–প্রজাতিকে ক্লোন করে এই অচিন্তনীয় প্রতিভাধর শিশু তৈরি করা হয়েছে তাদের ভিতরে মানবিক কোনো চেতনা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা যে–প্রশ্ন করেছে তার উত্তর জানার জন্যে এই মানবিক অনুভূতিগুলো থাকার প্রয়োজন। সেই অনুভূতি ছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর তারা কেমন করে অনুভব করবে? নজীবউল্লাহ আড়চোখে শরীফ আকন্দের দিকে তাকিয়ে নিচুগলায় বলল, আমি আগেই বলেছিলাম এই ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই।
শরীফ আকন্দ ফিসফিস করে বলল, এখন কী করতে চাও?
আমাদের প্রশ্নটা বাতিল করে দিই।
শরীফ আকন্দ মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
নজীবউল্লাহ গলার স্বর উঁচু করে বলল, আমরা যে–প্রশ্নটি করেছি তার উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। প্রশ্নটা বাতিল করে দিচ্ছি।
প্রায়োরিটি কোডিং কত?