হ্যাঁ! একডজন শিশুকে আমি পুরোপুরি অন্ধকারে বড় করেছি। আলো কী তারা জানে না–তারা কখনো সেটা দেখে নি।
তুমি তাদের কেমন করে দ্যাখ?
ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে। এই দ্যাখ।
হাজীব একটু এগিয়ে গিয়ে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই বড় একটা স্ক্রিনে কিছু ছবি ভেসে উঠল। বড় বড় চুল, বড় বড় নখ, বুনো পশুর মতো নানা বয়সী কিছু মানুষ ইতস্তত হাঁটছে, মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে, তাদের দৃষ্টিশক্তি নেই কিন্তু তারা সেটি জানে না।
এই মানুষগুলোর স্পর্শশক্তি ভয়ংকর প্রবল। ঘ্রাণশক্তিও অনেক বেশি। দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার না করে থাকার মাঝে কোনো অসুবিধে আছে বলেই মনে হয় না।
রাহান হঠাৎ করে ঘুরে হাজীবের দিকে তাকাল, বলল, তুমি কেন আমাকে এসব দেখাচ্ছ?
কারণ আমি তোমাকে এখানে রেখে যাব।
রাহান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, কী বললে!
হ্যাঁ।
এই অন্ধকারের মানুষের কাছে আমি তোমাকে রেখে যাব। আমার খুব কৌতূহল একজন নতুন অতিথি পেলে তারা কী করে সেটা দেখার।
তুমি কী বলছ এসব!
ঠিকই বলছি। নির্বোধ আহাম্মক একটা সাংবাদিককে একটা কাজে ব্যবহার করা যাক। কী বলো?
রাহান বিস্ফারিত চোখে দেখল হাজীবের হাতে ছোট একটি রিভলবার। হাজীব মুখে তার সেই ভয়ংকর হাসিটি ফুটিয়ে বলল, তোমাকে এখনই ঠিক করতে হবে তুমি কী করবে? একটু বাধা দিলেই আমি তোমাকে গুলি করব। এটি আমার জগৎ–এখানে আমি ছাড়া কেউ আসে না। কেউ জানবে না কী হয়েছে।
হাজীব কথা শেষ করার আগেই রাহান তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং হাজীব এতটুকু দ্বিধা না করে রিভলবারের পুরো ম্যাগজিনটি তার উপরে শেষ করল। গুলির শব্দ গ্রানাইটের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় এবং পশু হিসেবে বেড়ে-ওঠা মানবশিশুগুলো আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। রাহানের দেহ একটা বড় পাথরের ওপর ছিটকে পড়ে।
হাজীব একটা নিশ্বাস ফেলে রিভলবারটি তার পকেটে রেখে গাড়ির কাছে ফিরে যায়। সেখানে এক বোতল উত্তেজক পানীয় রাখা আছে তার স্নায়ুকে শীতল করার জন্যে এখন সেটি দরকার। সে বহুদিন পর কাউকে নিজের হাতে খুন করল, একধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করল হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়াটিতে সে একধরনের প্রশান্তি অনুভব করছে।
উত্তেজক পানীয়টির দ্বিতীয় ঢোক খাওয়ার পর হঠাৎ করে তার মনে একটি খটকা লাগল। রাহানের শরীরে ছয়টি গুলি লাগার পরও শরীরে সে পরিমাণ রক্ত বের হল না কেন। সন্দেহ নিরসনের জন্যে সে পিছনে ফিরে তাকাল–কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। রাহান নিঃশব্দে উঠে এসে তাকে পিছন থেকে আঘাত করেছে– এক টুকরো পাথর অত্যন্ত আদিম অস্ত্র, কিন্তু এখনো সেটি চমৎকার কাজ করে।
রাহান হাজীবের অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমাকে তুমি যত আহাম্মক ভেবেছিলে আমি তত আহাম্মক নই। আমার গায়ে ক্যাভলারের একটা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট লাগানো আছে–তোমার সাথে এমনি দেখা করতে আমার সাহস হয় নি।
রাহান হাজীবের অচেতন শরীরটি টেনে অন্ধকার জগতের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। অন্ধকার-জগতের মানুষেরা নতুন অতিথি পেলে কী করে সেটি জানার হাজীবের খুব কৌতূহল ছিল। কিছুক্ষণেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে–এই কৌতূহলটি সে মিটিয়ে নেবে তখন।
হাজীবের এই চিড়িয়াখানার কথা কেউ জানে না। তাকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না। নিজের সৃষ্টির সাথে সে তার জীবনের বাকি অংশটুকু কাটিয়ে দেবে।
কে জানে ড. ম্যাঙ্গেলাকে নিয়ে তার ধারণার পরিবর্তন হবে কিনা!
নিউরাল কম্পিউটার
বিজ্ঞাপনটি শরীফ আকন্দের খুব পছন্দ হল। ছোট টাইপে লেখা।
সব সমস্যার সমাধান থাকে না–
কিন্তু যদি থাকে
আমরা সেটা বের করে দেব!
পাশে একটা চিন্তিত মানুষের ছবি। মানুষটিকে ঘিরে পটভূমিতে কিছু কঠিন সমীকরণ, কিছু যন্ত্রপাতি। একটা ভাস্কর্য, কয়েকটা খোলা বই। কঠোর চেহারার একজন সৈনিক এবং কিছু ক্ষুধার্ত শিশুর ছবি। বিজ্ঞাপনটি দেখলেই বোঝা যায় সমস্যা বলতে শুধু বিজ্ঞান বা গণিতের সমস্যা বোঝানো হচ্ছে না, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতির সমস্যাও বোঝানো হচ্ছে।
শরীফ আকন্দ জিভ দিয়ে পরিতৃপ্তির একটা শব্দ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে সামনে বসে থাকা নজীবউল্লাহকে জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয় তোমার নজীব? এইবারে কি হবে? কথার মাঝে জোর থাকল হবে কথাটির মাঝে।
নজীব আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিয়ে বলল, কেমন করে বলি? এর আগেরবারও তো ভেবেছিলাম হয়ে যাবে–সেবারেও তো হল না।
শরীফ ভুরু কুঁচকে বলল, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তার সংজ্ঞা নিয়ে সমস্যা। এবারে অন্তত সেরকম কিছু তো নেই।
তা নেই কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেব না। যখনই আমাদের কাছে কেউ জানতে চেয়েছে আমাদের সিস্টেম কী–প্লটফরম কী–আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। বড়জোর বলা হবে নিজস্ব সুপার কম্পিউটার, আলট্রা কম্পিউটার আর নিউরাল কম্পিউটার!
নিউরাল কম্পিউটার! শরীফ দরাজ–গলায় হা হা করে হেসে উঠল, এই নামটা খুব ভালো দেওয়া হয়েছে।
নজীব জকুটি করে বলল, কেন? নিউরাল কম্পিউটার কি ভুল বলা হল?
না না–ভুল কেন হবে? শরীফ আকন্দ দুলে দুলে হেসে বলল, ভুল নয় বলেই তো তোমাকে বলছি। শরীফ টেবিলে রাখা গ্লাসের তরল পদার্থে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তোমার এই বিজ্ঞাপনের রি–একশান কী?