তপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভয় করছে আম্মু। আমার খুব ভয় করছে।
ভয় কী বাবা? তোর ভয় কিসের?
শিরীন ঘরের লাইট জ্বালিয়ে তপুর কাছে এগিয়ে যায়। মশারি তুলে তপুর কাছে গিয়ে বসল। হাঁটুর ওপরে মুখ রেখে বসেছে, চোখ থেকে পানি বের হয়ে গাল ভিজে আছে। চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থের মতো, একধরনের আতঙ্ক নিয়ে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আছে। হাত দুটি পিছনে, অত্যন্ত বিচিত্র একটি বসে থাকার ভঙ্গি। শিরীন তপুর পিঠে হাত রেখে বলল, তোকে না কম্পিউটার চালাতে নিষেধ করেছিলাম?
আমি চালাই নি আম্মু। বিশ্বাস কর আমি চালাই নি।
তাহলে কে চালিয়েছে?
তপু ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলল, আমি জানি না।
ঠিক আছে বাবা, কম্পিউটার বন্ধ করে দিচ্ছি।
তপু হঠাৎ চিৎকার করে বলল, না।
না! শিরীন অবাক হয়ে বলল, কেন না?
আমার ভয় করে আম্মু–আমি বলতে পারব না—
শিরীন অবাক হয়ে তপুর পিঠে হাত বুলিয়ে হাতটা নিচে আনতেই হঠাৎ সেখানে একটা ধাতব শীতল স্পর্শ অনুভব করল। পিছনে তাকাতেই সে অবাক হয়ে দেখল তপু দুই হাতে একটা চাকু ধরে রেখেছে। রান্নাঘরে এই চাকু দিয়ে সে শাকসজি কাটে। শিরীনের মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে তপু দুই হাতে চাকুটা উপরে তুলে শিরীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
শিরীন প্রস্তুত ছিল বলে ঝটকা মেরে একপাশে সরে গেল এবং তপুর চাকুটা বিছানার ভেতরে ঢুকে গেল। শিরীন চিৎকার করে তপুর হাতটা খপ করে ধরে ফেলল কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল এইটুকু মানুষের শরীরে ভয়ঙ্কর জোর। তপু হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে আবার চাকুটা উপরে তুলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলল, আম্মু আমি মারতে চাই না আম্মু কিন্তু আমি কী করব। আমাকে বলেছে মারতেই হবে– তপু কথা শেষ করার আগেই আবার চাকুটি নিয়ে শিরীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিরীন ঝটকা মেরে আবার সরে গিয়ে টেবিলের নিচে ঢুকে গেল। ভয়ংকর আতঙ্ক নিয়ে দেখল তপু চাকুটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে–কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসছে, তার কিছু করার নেই, তাকে কেউ একজন আদেশ দিচ্ছে, সেই আদেশ সে অমান্য করতে পারবে না।
শিরীন দেখল তপু আরো একটু এগিয়ে এসেছে, ঠিক তখন সে কম্পিউটারের পাওয়ার কর্ডটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। একটা চাপা শব্দ করে মনিটরটি অন্ধকার হয়ে গেল এবং সাথে সাথে তপু মাটিতে টলে পড়ে গেল। শিরীন কাছে গিয়ে দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তপুকে বুকে চেপে ধরে সে বের হয়ে আসে হামাগুড়ি দিয়ে সে টেলিফোনের কাছে ছুটতে থাকে– তাকে এখন হাসপাতালে নিতে হবে। তাকে বাঁচাতে হবে।
.
মাসখানেক পরের কথা। শাহেদের রুমে শিরীন তার সাথে কথা বলছে। শাহেদ হাসিমুখে বলল, আপনার অনুমান সত্যি। আপনার কথা বিশ্বাস করলে আরো অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত।
শিরীন কোনো কথা বলল না। শাহেদ বলল, কিন্তু ব্যাপারটি বিশ্বাস করবে কীভাবে? এটা তো বিশ্বাস করার কথা নয়। একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম বাচ্চাদের সম্মোহিত করে ভয়ংকর ভয়ংকর ব্যাপার ঘটাচ্ছে, এটা কি বিশ্বাস করা যায়?
শিরীন মাথা নাড়ল। বলল, তা যায় না।
আপনার ছেলে এখন কেমন আছে?
ভালো। প্রতিদিন বিকেলে এখন আমি ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিই খেলার জন্যে। দৌড়াদৌড়ি করার জন্যে।
ভেরি গুড। ঐ রাতের ঘটনা কিছু মনে করতে পারে?
না, পারে না। আমি চাইও না তার মনে পড়ুক।
শাহেদ হাসার চেষ্টা করে বলল, ঠিকই বলেছেন।
শিরীন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঐ স্ক্রিন সেভারটা কে তৈরি করেছে সেটা কি বের করতে পেরেছে?
শাহেদ মাথা নাড়ল, বলল, না। অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু এখনো বের করতে পারে নি। স্ক্রিন সেভারটা এত অদ্ভুত এত অস্বাভাবিক যে সবাই একটা অন্য জিনিস সন্দেহ করছে।
কী সন্দেহ করছে?
এটা কোনো মানুষ লেখে নি।
তাহলে কে লিখেছে?
ইন্টারনেট।
ইন্টারনেট?
হ্যাঁ–ইন্টারনেট হচ্ছে অসংখ্য কম্পিউটারের একটা নেটওয়ার্ক–ঠিক মানুষের মস্তিষ্কের মতো। অনেকে মনে করছে পৃথিবীর ইন্টারনেটের বুদ্ধিমত্তা এখন মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি।
মানে?
তার মানে মানুষ নেটওয়ার্ককে নিয়ন্ত্রণ করছে না। নেটওয়ার্কই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
শিরীন চমকে উঠে বলল, কী বলছেন আপনি!
হ্যাঁ, সবাই ধারণা করছে এই স্ক্রিন সেভারটি ছিল তাদের প্রথম চেষ্টা–পরের বার আক্রমণটা হবে আরো পরিকল্পিত। আরো ভয়ানক।
শিরীন কোন কথা না বলে চোখ বড় বড় করে শাহেদের দিকে তাকিয়ে রইল।