শিরীন ইতস্তত করে বলল, কিন্তু কম্পিউষ্টার গেম নয়–স্ক্রিন সেভার থেকে কি কোনো ক্ষতি হতে পারে?
শাহেদ হেসে বলল, স্ক্রিন সেভারটা তৈরি হয়েছে স্ক্রিনের ফসফরকে বাঁচানোর জন্যে। কোনো একটা ডিজাইন, নকশা, এটা দেখে আর কী ক্ষতি হবে। তবে
তবে?
যাদের এপিলেন্সি আছে তাদেরকে কম্পিউটার গেম খেলতে নিষেধ করে। কোথায় নাকি স্টাডি করে দেখেছে মনিটরের ফ্লিকার দেখে তাদের সিজুর ট্রিগার করতে পারে। আমি নিজে দেখি নি, শুনেছি।
শাহেদ কথা থামিয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ আপনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?
শিরীন পুরো ব্যাপারটি খুলে বলবে কিনা চিন্তা করল, কিন্তু হঠাৎ তার কেমন জানি সংকোচ হল। সে মাথা নেড়ে বলল, না, এমনিই জানতে চাচ্ছিলাম।
.
শাহেদের সাথে কথা বলে শিরীন নিজের টেবিলে এসে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকে। তার মাথায় কয়দিন থেকেই একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই সন্দেহটা আরো প্রবলভাবে নিজের উপর চেপে বসছে। শেষ পর্যন্ত সে সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, ডাইরি থেকে টেলিফোন নাম্বার বের করে দৈনিক প্রথম খবরে ফোন করে হাসান জামিলের সাথে কথা বলতে চাইল। কিছুক্ষণের মাঝেই টেলিফোনে একজনের ভারী গলা শুনতে পেল, হ্যাঁলো হাসান জামিল।
শিরীন এর আগে কখনো খবরের কাগজের অফিসে ফোন করে নি, খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি আপনাদের পত্রিকার একজন পাঠক।
জি। কী ব্যাপার?
বেশ কয়েকদিন আগে আপনি আপনাদের পত্রিকায় দুর্বোধ্য কৈশোর নামে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন।
হ্যাঁ লিখেছিলাম। অনেক টেলিফোন কল পেয়েছিলাম তখন।
আমিও সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইছি। শিরীন একটু ইতস্তত করে বলল, সেই ব্যাপার নিয়ে আমি একটা জিনিস জানতে চাইছি।
কী জিনিস?
আপনি যেসব কিশোর–কিশোরীর কথা লিখেছেন, আই মিন যারা খুন করেছে বা আত্মহত্যা করেছে বা অন্যভাবে ডিস্টার্ব তাদের কি কোনোভাবে কম্পিউটারের সাথে সম্পর্ক আছে? মানে তারা কি এর আগে কোনোভাবে কম্পিউটার দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে?
হাসান জামিল টেলিফোনের অন্য পাশে দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল, খুব অবাক ব্যাপার যে আপনি এটা জিজ্ঞেস করলেন। ব্যাপারটা আমরাও লক্ষ করেছি– যারা যারা ডিস্টার্বড সবাই কম্পিউটারে অনেক সময় দেয়, কিন্তু সেটাকে আমরা কোনো কো–রিলেশান হিসেবে ধরি নি।
কেন ধরেন নি?
মনে করুন সবাই তো নিশ্চয়ই সকালে নাস্তা করে, দুপুরে ভাত খায়; তাহলে কি বলব যারা সকালে নাস্তা করে কিংবা দুপুরে ভাত খায় তারা সবাই ডিস্টার্বড।
শিরীন একটু ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, এটা খুব বাজে যুক্তি।
যুক্তি পছন্দ না হলেই আপনারা বলেন বাজে যুক্তি।
আপনি যেসব কিশোর-কিশোরীর কথা লিখেছেন তাদের সবাই কি ঘটনার আগে আগে কম্পিউটারের কোনো একটা বিশেষ জিনিস নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে ছিল না? সামথিং ভেরি স্পেসিফিক?
হাসান জামিল আমতা আমতা করে বললেন, ইয়ে সেরকম একটা কথা আমরা শুনেছি। কনফার্ম করতে পারি নি।
সাংবাদিক হিসেবে আপনাদের কি দায়িত্ব ছিল না কনফার্ম করা?
দেখুন আমরা সাংবাদিক, তার অর্থ এই নয় যে আমরা সমাজের বাইরে। সমাজের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। আমরা চেষ্টা করছি দেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে। এখন যদি কম্পিউটার নিয়ে একটা ভীতি ছড়িয়ে দিই–অকারণ ভীতি–
অকারণ ভীতি? অকারণ?
যেটা প্রমাণিত হয় নি
আপনারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি
হাসান জামিল আবার আমতা আমতা করে কিছু–একটা বলতে চাইছিল কিন্তু শিরীনের আর কিছু শোনার ধৈর্য থাকল না। সে রেগেমেগে টেলিফোনটা রেখে গুম হয়ে টেবিলে বসে রইল।
.
একটা চাপা দুশ্চিন্তা নিয়ে শিরীন বাসায় ফিরে এসে দেখে তপু বসে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শিরীনকে দেখে হাত তুলে বলল, আম্মু, তুমি এসেছ!
হ্যাঁ, বাবা। তোর কী খবর?
বাংলা খবর বলে তপু হি হি করে হাসল। এটা একটা অত্যন্ত পুরাতন এবং বহুলব্যবহৃত রসিকতা, তবুও শুনে শিরীনও হাসল এবং হঠাৎ করে তার মন ভালো হয়ে গেল। শিরীন তপুর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে খানিকক্ষণ এটা–সেটা নিয়ে কথা বলে আসল প্রসঙ্গে চলে এল। বলল, তপু।
কী আম্মু!
আমি ঠিক করেছি তুই এখন কয়েকদিন কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবি না।
শিরীন ভেবেছিল তপু নিশ্চয়ই চিৎকার করে আপত্তি করবে, নানারকম ওজর-আপত্তি তুলবে, নানা যুক্তি দেখাবে। কিন্তু সে কিছুই করল না, অত্যন্ত বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে আম্মু।
.
গভীর রাতে হঠাৎ শিরীনের ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক কেন ঘুম ভেঙেছে সে বুঝতে পারল না, তার শুধু মনে হল খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে কিন্তু সেটা কী সে বুঝতে পারছে না। সে চোখ খুলে তাকাল। তার মনে হল সারা বাসায় হালকা নীল একটা আলো। শুধু তাই নয়, মনে হল খুব চাপাস্বরে কেউ একজন কাঁদছে, ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না। শিরীন ধড়মড় করে উঠে বসল। আলোটা মনের ভুল নয়, সত্যিই হালকা নীল রঙের একটা আলো। কিসের আলো এটা?
শিরীন বিছানা থেকে নেমে নিজের ঘর থেকে বের হতেই দেখল তপুর ঘরের দরজা আধখোলা, আলোটা তার ঘর থেকে আসছে। শিরীন প্রায় ছুটে সেই ঘরে ঢুকে আলোর উৎসটা আবিষ্কার করল, কম্পিউটারের মনিটরের আলো। মনিটরে বিচিত্র একটা ছবি, সেটি ধীরে ধীরে নড়ছে এবং স্পিকার থেকে চাপা কান্নার মতো একটা শব্দ হচ্ছে মনে হচ্ছে। ঝড়ো বাতাসের শব্দ, তার মাঝে কেউ একজন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। মনিটরের অপার্থিব নীল আলোতে তপুর ঘরটিকে একটি অপার্থিব জগতের দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে। শিরীন অবাক হয়ে তপুর বিছানার দিকে তাকাল, বিছানার এক কোনায় তপু গুটিশুটি মেরে বসে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে। শিরীন কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর, তপু? কী হয়েছে?