হাজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, মানুষ।
রাহান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে এবং আবার মাথা ঘুরিয়ে ছোট ফুটো দিয়ে উঁকি দিল এবং আতঙ্কে শিউরে উঠে আবিষ্কার করল সত্যিই এই প্রাণীগুলো মানুষ। সে ফ্যাকাসে মুখে হাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষগুলো এরকম কেন?
আমি আইডিয়াটি পেয়েছিলাম একটি বিশেষ ঘটনা থেকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে একটি নেকড়ে বাঘের গর্তে দুটি মেয়ে পাওয়া গিয়েছিল। একটির বয়স ছিল সাত–আট, অন্যটি আরো একটু বড়, বারো–তের। নেকড়ে বাঘ তাদেরকে গ্রাম থেকে ধরে এনে বড় করেছিল। মানুষেরা তাদের উদ্ধার করে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়। নি। শৈশব নেকড়ে বাঘের সাথে কাটানোর জন্যে তারা বন্য পশুর মতোই থেকে গিয়েছিল। মানুষের কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। চারপায়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটত, কাঁচা মাংস খেত, গায়ে কাপড় রাখত না, তীক্ষ্ণ ছিল ঘ্রাণশক্তি–এক কথায় পুরোপুরি বন্য পশু!
হাজীব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষের বাচ্চা দুটিকে উদ্ধার করে তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল অমলা আর কমলা। কিন্তু ঐটুকুই ছিল তাদের একমাত্র মানুষের পরিচয়।
রাহান এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে হাজীবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাজীব মুখে তার সেই ভয়ংকর অস্পষ্ট হাসিটা ফুটিয়ে বলল, ঘটনাটি শুনে আমার মনে হয়েছিল ইতিহাসে যদি এরকম একটি ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে কি আমরা আরো তৈরি করতে পারি না?
রাহান হতচকিত হয়ে হাজীবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তুমি এদের তৈরি করেছ?
হ্যাঁ। হাজীব মাথা নাড়ল, বলল, কাজটি খুব সহজ হয় নি। অনেক শিশু নষ্ট হয়েছে। সব নেকড়ে–মাতাই যে মানবশিশুকে নিজের শিশু হিসেবে বড় করতে চায় সেটা সত্যি নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা পেরেছিএখানে পাঁচটি নেকড়ে–মানব আছে। দুটি ছেলে, তিনটি মেয়ে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি এদের সন্তানেরা কীরকম হয় দেখার জন্যে।
রাহান ভয়ংকর একটি আতঙ্ক নিয়ে হাজীবের দিকে তাকিয়ে রইল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কি সত্যিই মানুষ নাকি একটি দানব হঠাৎ করে এই ব্যাপারটি নিয়ে তার সন্দেহ হতে থাকে।
হাজীব দুই পা হেঁটে বলল, আমার মনে হল, মানবশিশু যদি নেকড়েকে দিয়ে পালন করানো যায়, তাহলে অন্য পশু কেন নয়। তখন আমি পরীক্ষা শুরু করেছি। বাঘ, কুকুর, শিম্পাঞ্জি এমনকি ডলফিন।
ডলফিন?
হ্যাঁ। ঐপাশে পানির একটা ছোট হ্রদ আছে, সেখানে তিনজন ডলফিন শিশু থাকে। পানির নিচে সাঁতার কাটে, কাঁচা মাছ খায়। দেখে কেউ বলতেও পারবে না যে তারা আসলে ডাঙার প্রাণী। আমি পুরো বিবর্তনকে উল্টোদিকে প্রবাহিত করতে শুরু করেছি!
হাজীব শব্দ করে হাসল এবং রাহান হঠাৎ করে আবার আতঙ্কে শিউরে উঠল। হাজীব একটা বড় পাথরে বসে বলল, যাও রাহান, তুমি ঘুরে ঘুরে দ্যাখ। আমি এখানে অপেক্ষা করি। আমার মনে হয় শিম্পাঞ্জি–শিশুটিকে তুমি পছন্দই করবে–দেখে মনে হয় বিবর্তনের ফলে মাটিতে নেমে আমরা বুদ্ধিমানের কাজ করি নি। গাছটাই বুঝি ভালো ছিল?
রাহান শুষ্কমুখে বলল, আমার দেখার ইচ্ছে করছে না।
না করলে কেমন করে হবে? তুমি একজন অকুতোভয় ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিক। তুমি এটি দেখবে না? যাও, দেখে আস। কারণ তুমি এই সবগুলো দেখে এলে আমি আমার সর্বশেষ আবিষ্কারটি দেখাব।
কী আবিষ্কার?
হাজীব মাথা নাড়ল, বলল, সেটা আমি আগেই বলব না। রাহান তুমি বুঝতে পারছ যে তুমি কতবড় সৌভাগ্যবান মানুষ। আমার এই চিড়িয়াখানায় এর আগে কোনো মানুষ আসে নি। এটি আমার খুব ব্যক্তিগত জায়গা। যখন কোনোকিছু নিয়ে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয় তখন আমি এখানে আসি। এই পশু–শিশুগুলো দেখলে আমার স্নায়ুগুলো নিজে থেকে শীতল হয়ে আসে। আমি মাঝে মাঝে এসে এক সপ্তাহ–দুসপ্তাহও থাকি। ঐপাশে আমার একটা ছোট ঘর আছে। এটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত আনন্দভূমি। এখানে আজ আমি তোমাকে এনেছি তুমি উপভোগ না করলে কেমন করে হবে?
রাহান মাথা নাড়ল, বলল, না হাজীব–আমার পক্ষে এটা উপভোগ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু তুমি সাংবাদিক আমার সম্পর্কে তুমি যদি পূর্ণাঙ্গ একটা রিপোর্ট লিখতে চাও তাহলে কি পুরোটা দেখা উচিত নয়?
হাজীবের কথায় শ্লেষটুকু ধরতে রাহানের কোনো অসুবিধে হল না এবং হঠাৎ করে সে এক অমানুষিক ধরনের আতঙ্কে শিউরে ওঠে। হাজীব রাহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি যদি দেখতে না চাও তোমাকে আমি জোর করে দেখাতে পারব না। তবে আমার শেষ আবিষ্কারটি তোমাকে দেখতে হবে।
তোমার আবিষ্কারটি কী?
বলতে পার এ ব্যাপারে আমরা গুরু হচ্ছে ড. ম্যাঙ্গেলা। নাৎসি জার্মানির একজন ডাক্তার। মানুষকে নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর পরীক্ষাগুলো করেছিলেন তিনি।
সুন্দর?
হ্যাঁ। সাধারণ মানুষ ভীতু। জৈব পরীক্ষাগুলো করে পশুপাখিদের ওপর। কিন্তু সরাসরি মানুষের ওপর পরীক্ষা করার মতো আনন্দ আর কোথায় পাবে। ড, ম্যাঙ্গেলা সেই পরীক্ষা করতেন। তাদের বিকলাঙ্গ করতেন, অত্যাচার করতেন। তার কোনো সংকোচ ছিল না।
রাহান নিশ্বাস আটকে বলল, তুমিও করেছ?
হ্যাঁ। আমি শুরু করেছি। প্রথম পরীক্ষাটি খুব সহজ। মানবশিশুদের যদি জন্মের পর থেকে অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে?
তুমি সেই পরীক্ষাটি করেছ?