শিরীন প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল, এবং ঠিক কী কারণ জানা নেই পড়ার পর থেকে সে কেমন যেন শঙ্কা অনুভব করতে থাকে। দুর্বোধ্য কিশোর–কিশোরীর যে প্রোফাইলটা দেওয়া হয়েছে তার সাথে তপুর কেমন যেন একটা মিল রয়েছে। সবচেয়ে যেটা ভয়ের কথা, ইদানীং শিরীনের মনে হচ্ছে তপুর সাথে তার কেমন জানি একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।
রাত্রে খাবার টেবিলে শিরীন ইচ্ছে করে তপুর সাথে একটু বেশি সময় নিয়ে কথা বলল; তার স্কুলের, বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর নিল। শিরীন লক্ষ করল তপুকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে কিন্তু নিজে থেকে কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে খানিকটা অন্যমনস্ক প্রশ্ন করলেও মাঝে মাঝে উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে, প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করতে হচ্ছে। শিরীন কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কী হয়েছে তোর? কথা বলছিস না কেন?
কে বলেছে কথা বলছি না?
দশটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দিচ্ছিস। কী হয়েছে?
কিছু হয় নাই।
শিরীন লক্ষ করল তপু জোর করে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কথায় যেন প্রাণ নেই। জোর করে, চেষ্টা করে কষ্ট করে বানিয়ে বানিয়ে বলছে। বলার ইচ্ছে করছে না কিন্তু শিরীনকে খুশি করার জন্যে বলছে।
রাত্রে ঘুমানোর আগে শিরীন তপুর ঘরে গিয়ে দেখে সে কম্পিউটারের মনিটরের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। মনিটরে বিচিত্র একটি নকশা খুব ধীরে ধীরে নড়ছে, তার সাথে সাথে স্পিকার থেকে খুব হালকা একটি সঙ্গীত ভেসে আসছে। তপুর দৃষ্টি সম্মোহিত, মুখ অল্প খোলা। কিছু একটা দেখে যেন সে ভারি অবাক হচ্ছে, নিচের ঠোঁট অল্প অল্প নড়ছে। শুধু তাই নয়, শিরীন অবাক হয়ে দেখল, তপু যেন ফিসফিস করে কিছু–একটা বলছে, যেন অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলছে। শিরীন কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল, চাপা গলায় ডাকল, তপু।
তপু শুনতে পেল বলে মনে হল না, শিরীন তখন আবার ডাকল, তপু। আগের থেকে জোরে ডেকেছে তপু তবুও ঘুরে তাকাল না। শিরীন এবারে তপুকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তপু, এই তপু, কী হয়েছে তোর?
তপু খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে শিরীনের দিকে তাকাল, শিরীন তার দৃষ্টি দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। শূন্য এবং অপ্রকৃতিস্থ একধরনের দৃষ্টি, শিরীনের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু মনে হচ্ছে সে কিছু দেখছে না। শিরীন আবার চিৎকার করে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল, তপু,এই তপু।
তপু কাঁপা গলায় বলল, কী!
কী হয়েছে তোর?
তপু সম্মোহিতের মতো বলল, কিছু হয় নি।
কার সাথে কথা বলছিস তুই?
সেভারের সাথে।
সেভার? সেতার কে?
স্ক্রিন সেভার। লাইফ সেভার। নেট সেভার। সোল সেভার।
শিরীন চিৎকার করে বলল, কী বলছিস তুই পাগলের মতো? তপু, কী হয়েছে তোর?
তপু হঠাৎ করে যেন জেগে উঠল, অবাক হয়ে তাকাল শিরীনের দিকে, বলল, কী হয়েছে আম্মু?
তোর কী হয়েছে?
আমার? আমার কিছু হয় নি।
তাহলে এখানে এভাবে বসে ছিলি কেন? কার সাথে তুই কথা বলছিলি?
তপুকে হঠাৎ যেন কেমন বিভ্রান্ত দেখায়, কী যেন চিন্তা করে ভুরু কুঁচকে তারপর মাথা নেড়ে বলল, মনে নেই আম্মু। কী যেন একটা খুব ইম্পরট্যান্ট একটা ব্যাপার। খুব। জরুরি–
শিরীন হঠাৎ করে কেমন জানি খেপে গেল, চিৎকার করে বলল, বন্ধ কর কম্পিউটার। এক্ষুনি বন্ধ কর। বন্ধ কর বলছি।
তপু কেমন জানি ভয় পেয়ে কম্পিউটার বন্ধ করে শিরীনের দিকে তাকাল। শিরীন হিংস্র গলায় বলল, আর কোনোদিন তুই কম্পিউটারের সামনে বসতে পারবি না। নেভার। বুঝেছিস?
তপু অবাক হয়ে শিরীনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না তার আম্মু কী বলছে।
.
রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে শিরীন শুনতে পেল তপু ঘুমের মাঝে বিছানায় ছটফট করছে। মনে হয় বুঝি কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। শিরীন তপুর মাথার কাছে বসে রইল, শেষ পর্যন্ত যখন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তখন সে নিজের বিছানায় এল শোয়ার জন্যে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল–তার চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না।
.
পরদিন দুপুরের পর শিরীন তাদের অফিসের সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটর শাহেদ আহমেদকে খুঁজে বের করল। যে–কোনো সিস্টেম এডমিনের মতোই শাহেদ কমবয়সী, উৎসাহী এবং হাসিখুশি মানুষ। শিরীনকে দেখে বলল, কী হয়েছে আপা? সিস্টেম ডাউন?
না, না, সিস্টেম ঠিকই আছে।
তাহলে?
আপনি তো কম্পিউটারের এক্সপার্ট, আপনাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি।
কী জিনিস?
শিরীন ইতস্তত করে বলল, কম্পিউটার কি ছোট বাচ্চাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?
অবশ্যই পারে। শাহেদ উজ্জ্বল চোখে বলল, কম্পিউটার হচ্ছে একটা টুল। এই টুলটা ব্যবহার করে কতকিছু করা যায়, কতকিছু শেখা যায়–
না, না– শিরীন মাথা নেড়ে বলল, আমি ভালো প্রভাবের কথা বলছি না, খারাপ প্রভাবের কথা বলছি।
শাহেদ এবারে সরু চোখে শিরীনের দিকে তাকাল, বলল, কীরকম খারাপ প্রভাব?
ধরুন, পাগল হয়ে যাওয়া?
শাহেদ হেসে বলল, না, সেরকম কিছু আমি কখনো শুনি নি।
কোনো কম্পিউটার গেম কি আছে যেটা খেললে বাচ্চাদের ক্ষতি হয়?
সেটা তো থাকতেই পারে। আজকাল কী ভয়ানক ভয়ানক ভায়োলেন্ট গেম তৈরি করেছে। এত গ্রাফিক যে সেগুলো খেলে খেলে বাচ্চারা ইনসেনসেটিভ হয়ে যেতে পারে। ভায়োলেন্সে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে। গত বছর দুটি ছেলে আমেরিকার স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের গুলি করে মারল–তারা নাকি কী একটা কম্পিউটার গেম থেকে খুন করার আইডিয়াটা পেয়েছে?