তপু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ!
.
পড়াশোনা শেষ করে তপু খানিকক্ষণ টিভি দেখে, টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম না থাকলে কম্পিউটার নিয়ে খেলে। সবার কাছে কম্পিউটার কম্পিউটার শুনে শিরীন ছেলেকে একটা কিনে দিয়েছে– অনেকগুলো টাকা লেগেছে কিন্তু তবুও তপুর শখ মিটিয়ে দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সেমিনার, বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছিল ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দিলেই সে হয়তো হাতি ঘোড়া অনেকরকম সৃর্জনশীল কাজ করে দেবে কিন্তু সেরকম কিছু দেখা যায় নি। বন্ধুবান্ধবের সাথে গেম বিনিময় করে, ইন্টারনেট থেকে মাঝে মাঝে কোনো ছবি বা গান ডাউনলোড করে, মোটামুটি তাড়াতাড়ি টাইপ করে কিছু–একটা লিখতে পারে এর চাইতে বেশি কিছু হয়নি। এতগুলো টাকা শুধুশুধু অপচয় করল কিনা সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে শিরীনের সন্দেহ হয়।
ঘুমানোর আগে প্রায় প্রতিদিনই তপু কম্পিউটার গেম খেলে, তখন তপুর ঘর থেকে গোলাগুলি, মহাকাশযানের গর্জন কিংবা মহাকাশের প্রাণীর চিৎকার শোনা যায়। আজকে ঘরে কোনো শব্দ নেই, শিরীন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিঃশব্দে ছেলের ঘরে হাজির হল। গিয়ে দেখে তপু কেমন জানি সম্মোহিতের মতো কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সামনে মনিটরের স্ক্রিনে একটি অত্যন্ত বিচিত্র নকশার মতো ছবি, খুব ধীরে ধীরে সেটি নড়ছে। কান পেতে থাকলে কম্পিউটারের স্পিকার থেকে খুব মৃদু একটি অতিপ্রাকৃত সংগীতের মতো কিছু একটা ভেসে আসতে শোনা যায়। শিরীন কিছুক্ষণ তপুর দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে ডাকল, তপু।
তপু চমকে উঠে শিরীনের দিকে তাকাল। শিরীন অবাক হয়ে দেখল, তপুর দৃষ্টি কেমন জানি অপ্রকৃতিস্থর মতো। ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর?
তপু বলল, কিছু হয় নাই।
স্ক্রিনের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
এমনি। তপু এমনভাবে মাথা নিচু করল যে দেখে শিরীনের মনে হল সে একটা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে।
শিরীন বলল, এমনি এমনি কেউ এভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকায়?
না। মানে এই যে স্ক্রিন সেভারটা আছে সেটার দিকে তাকালে মাঝে মাঝে অন্য জিনিস দেখা যায়।
অন্য জিনিস? শিরীন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, অন্য কী জিনিস?
তপু ঠিক বোঝাতে পারল না, ঘাড় নেড়ে বলল, মনে হয় কেউ কথা বলছে।
কথা বলছে? কী কথা বলছে?
জানি না।
দেখি আমি। শিরীন তপুর পাশে বসে দেখার চেষ্টা করল, অবাক হয়ে লক্ষ করল মনিটরের নকশাটি এমনভাবে ধীরে ধীরে নড়ছে যে মনে হয় সে বুঝি আদিগন্ত শূন্যতার মাঝে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। শিরীন চোখ সরিয়ে তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, কী সব উল্টাপাল্টা জিনিস দেখে সময় নষ্ট করছিস? বসে বসে প্রোগ্রামিং করতে পারিস না?
তপু যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল, বড় মানুষদের নিয়ে এটাই হচ্ছে সমস্যা, কোনো জিনিসের মাঝে আনন্দ রাখতে চায় না–সবসময়েই শুধু কাজ আর কাজ। বড় হয়ে সে প্রোগ্রামিঙের অনেক সুযোগ পাবে, এখন কয়দিন একটু মজা করে নিলে ক্ষতি কী? শিরীন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাতে যা।
শিরীন ভেবেছিল তপু আপত্তি করে খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করবে, কিন্তু সে আপত্তি করল না, সাথে সাথেই দুধ খেয়ে দাঁত ব্রাশ করে শুতে গেল। ডাইনিং টেবিলে কাগজপত্র ছড়িয়ে কাজ করতে করতে শিরীন শুনতে পেল তপু বিছানায় নড়াচড়া করছে। সাধারণত সে মোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে যায়, আজকে কোনো একটি কারণে তার চোখে ঘুম আসছে না।
রাত্রে ঘুমানোর আগে শিরীন কিছুক্ষণের জন্যে টিভিতে খবর শুনল। দেশ–বিদেশের খবর শেষ করে বলল, তের–চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করার আগে সে ইন্টারনেটে কয়েকজনের সাথে লিখে লিখে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে বলেছে এখন তার আত্মহত্যা করতে হবে। সবাই ভেবেছিল ঠাট্টা করছে কিন্তু দেখা গেল ঠাট্টা নয়।
খবরটা শুনে শিরীনের মনটা খারাপ হয়ে যায়। বয়োসন্ধির সময়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি কিশোর–কিশোরী আত্মহত্যা করে। কিন্তু যারা আত্মহত্যা করে তারা তো হঠাৎ করে সিদ্ধান্তটি নেয় না, দীর্ঘদিনে ধীরে ধীরে একটা প্রস্তুতি নেয়। ছেলেটির পরিবারের কেউ কি ছিল না যে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে পারত? সবার সাথেই কি একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল? তপু যখন আরেকটু বড় হয়ে বয়োসন্ধিতে পৌঁছাবে তখন কি তার সাথেও এরকম একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে? শিরীন তপুর ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, ছেলেটির চেহারায় এমনিতেই একটি নির্দোষ সারল্যের ভাব আছে, যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সেটা আরো এক শ গুণ বেড়ে যায়। শিরীন নিচু হয়ে তপুর গালে একটা চুমু খেয়ে মশারিটা ভালো করে গুঁজে দিয়ে লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে বের হয়ে এল।
অফিসে যাবার আগে তপুর সাথে নাস্তা খাওয়ার সময় খবরের কাগজে চোখ বুলাতে গিয়ে শিরীনের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। গতকাল যে–ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে তার ছবি ছাপা হয়েছে। ফুটফুটে বুদ্ধিদীপ্ত একটা কিশোর। পাশে আরেকটা ছবি, ছেলের মৃতদেহের উপর মা আকুল হয়ে কাঁদছে। খবরের কাগজের মানুষগুলো কেমন করে এরকম ছবিগুলো ছাপায়? তাদের বুকের ভিতরে কি কোনো অনুভূতি নেই?
সপ্তাহখানেক পর দৈনিক প্রথম খবরে হাসান জামিল নামে একজন দুর্বোধ্য কৈশোর নামে একটি বড় প্রতিবেদন লিখল। গত মাসখানেকের মাঝে কমবয়সী কিশোর–কিশোরী নিয়ে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, ঘটনাগুলো সত্যিই অস্বাভাবিক এবং দুর্বোধ্য। একজন খুন করেছে, আরেকজন খুন করার চেষ্টা করেছে। দুজন আত্মহত্যা করেছে, তিনজন নিখোঁজ। অন্তত আধডজন কিশোর–কিশোরী অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বড় একটা সংখ্যার। কিশোর–কিশোরী কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে একধরনের বিষণ্ণতায় ভুগছে। ঠিক কী কারণ কেউ জানে না। এই কিশোর–কিশোরীদের সবাই সচ্ছল পরিবারের, তুলনামূলকভাবে। সবাই পড়াশোনায় ভালো, মেধাবী। সবাই শহরের ছেলেমেয়ে, একটা বড় অংশ খানিকটা নিঃসঙ্গ। হাসান জামিল নামক ভদ্রলোক ব্যাপারটি নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে নি। বেপরোয়া নগরজীবন, ড্রাগস, নিঃসঙ্গতা, পারিবারিক অশান্তি, পাশ্চাত্য জগতের প্রলোতন, টেলিভিশন, প্রেম–ভালবাসা কিছুই বাকি রাখে নি, কিন্তু হঠাৎ করে কেন এতগুলো কিশোর–কিশোরীর এ ধরনের একটা পরিণতি হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে দিতে পারে নি।