একটু পরেই শিরীন তপুর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল যে–মানুষটিকে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে বিছানায় পাঠানো হয়েছে, বালিশে মাথা রাখা মাত্রই সে ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে গেছে। তার নিজের ঘুম নিয়ে সমস্যা হয় মাঝে মাঝে, চোখে ঘুম আসতে চায় না, তখন ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম মেরে পড়ে থেকে একটা অন্য ধরনের ঘুমের মাঝে ডুবে থাকতে হয়। শিরীন তপুর দিকে তাকাল। ছেলেটি দেখতে তার বাবার মতো হয়েছে, উঁচু কপাল, খাড়া নাক, ঘন কালো চুল, টকটকে ফরসা রং। শিরীনের সাজ্জাদের কথা মনে পড়ল, যার এরকম একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে সে কেমন করে স্ত্রী–পুত্রকে ছেড়ে চলে যেতে পারে? কেমন আছে এখন সাজ্জাদ? যাদের জীবনের ছোট ছোট জিনিসে তৃপ্তি নেই তারা কি কখনো কোথাও শান্তি খুঁজে পায়?
শিরীন আবার তার টেবিলে ফিরে এসে কাগজপত্রগুলো নিজের কাছে টেনে নিল। অফিসের কাজ খুব বেড়ে গেছে, প্রতিদিনই সে অফিসের কিছু ফাইল বাসায় নিয়ে আসে। সেগুলো দেখে নোট লিখে রেডি করতে করতে ঘুমুতে দেরি হয়ে যায়। শিরীনের অবিশ্যি সেটা নিয়ে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এতদিনে সে শিখে গেছে পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা, মেয়েদের জন্যে আরো অনেক বেশি কঠিন। সময়মতো এই চাকরিটা পেয়ে গেছে বলে সে ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তা না হলে সাজ্জাদ চলে যাবার পর ছেলেটিকে নিয়ে সে কোথায় যেত কে জানে!
সকালে তপুকে নাস্তা করতে তাড়া দিতে দিতে শিরীন খবরের কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে নেয়, পুরো কাগজে পড়ার মতো কোনো খবর নেই। সারা পৃথিবীতেই কোনো মানুষের মনে যেন কোনো শান্তি নেই। কলারাডোতে একজন মানুষ বাচ্চাদের স্কুলে এসে সাতটা বাচ্চাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দেয় নি বলে মাগুরাতে একজন মানুষ তার স্ত্রীর মুখে এসিড ছুঁড়ে মেরেছে। ঢাকায় বারো বছরের একটা বাচ্চা তার ছোটবোনকে কুপিয়ে খুন করে ফেলেছে। শিরীন বিশ্বাস করতে পারে না তপুর বয়সী একটা ছেলে কেমন করে কুপিয়ে নিজের বোনকে মেরে ফেলতে পারে। শিরীন অবাক হয়ে ভাবল, পৃথিবীটা কী হয়ে যাচ্ছে!
অফিসে নিজের টেবিলে যাবার সময় শিরীন দেখল একাউন্টেন্ট কামাল সাহেবের টেবিলের সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়। তিনি হাতপা নেড়ে কিছু–একটা বর্ণনা করছেন, অন্যেরা আগ্রহ নিয়ে শুনছে। শিরীন শুনল কামাল সাহেব বলছেন, দেখে বোঝার উপায় নেই। শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে, পড়াশোনায় ভালো, কোনো সমস্যা নেই। হঠাৎ করে খেপে উঠল। রাত দুইটার সময় রান্নাঘর থেকে এই বড় একটা চাকু নিয়ে এইভাবে কুপিয়ে —
কামাল সাহেব তখন কুপিয়ে খুন করার দৃশ্যটি অভিনয় করে দেখালেন। দেখে শিরীনের কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠল। সে জিজ্ঞেস করেছে, কার কথা বলছেন?
আরে! আপনি আজকের পত্রিকা পড়েন নাই? এটা তো এখন টক অব দা টাউন। সোনালী ব্যাংকের ডি. জি. এমের ছেলের। বারো বছর বয়স। আমাদের ফ্ল্যাটে তার ভায়রা থাকে। ছেলেটা ছোটবোনকে খুন করে ফেলেছে। পড়েন নাই পত্রিকায়?
পড়েছি। শিরীন দুর্বল গলায় বলল, ভেরি স্যাড।
কামাল সাহেব মাথা নেড়ে প্রবল হতাশার ভঙ্গি করে বললেন, এই দেশে কোনো আইন নেই, কোনো সিস্টেম নেই। আমেরিকা হলে ব্যাপারটা স্টাডি করে বের করে ফেলত। আমার ছোট শালা নিউজার্সি থাকে। একবার তার অফিসে–
শিরীন নিজের টেবিলে যেতে যেতে শুনতে পেল কামাল সাহেব একটি অত্যন্ত বীভৎস খুনের বর্ণনা দিচ্ছেন, ঘুঁটিনাটিগুলো এমনভাবে বলছেন যে শুনে মনে হয় খুনটি তার চোখের সামনে হয়েছে। শুনে শিরীনের গা গুলিয়ে উঠতে লাগল।
.
ডাইনিং টেবিলে তপু চোখ বড় বড় করে বলল, আম্মু, জান কী হয়েছে?
কী হয়েছে?
আমাদের স্কুলে ক্লাস নাইনে একটা মেয়ে পড়ে, তার নাম রাফিয়া। তার একজন কাজিন আছে, মডেল স্কুলে পড়ে। সে তার ছোটবোনকে মেরে ফেলেছে। এত বড় চাকু দিয়ে–।
শিরীন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা বিষম খেল, আজকের দিনে এই ঘটনাটা তিনবার শুনতে হল। একটা ভালো ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়ায় না, কিন্তু ভয়ংকর নিষ্ঠুর আর বীভৎস ঘটনা সবার মুখে মুখে থাকে।
খুন করার আগে রাফিয়াকে একটা ই–মেইল পাঠিয়েছে। লিখেছে আই হ্যাঁভ টু ডু ইট। আমাকে এটা করতে হবে। তপু চোখ বড় বড় করে বলল, কীভাবে খুন করেছে জান?
শিরীন মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না। কিন্তু জানার কোনো ইচ্ছেও নেই। এইসব খুন–জখমের ব্যাপারে তোদের এত ইন্টারেস্ট কেন?
রগরগে খুনের বর্ণনাটা দিতে না–পেরে তপু একটু নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেল, এখন ছেলেটার কী হবে আম্মু? ফাঁসি হবে?
এত ছোট ছেলের ফাঁসি হয় না।
তাহলে কী হবে?
আমি ঠিক জানি না। বাচ্চা একটা ছেলে তো আর এমনি–এমনি খুন করে ফেলে না, নিশ্চয়ই পিছনে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। সেটা খুঁজে বের করে তার চিকিৎসা করতে হবে।
কী চিকিৎসা?
সাইকোলজিস্টরা বলতে পারবে। আমি তো আর সাইকোলজিস্ট না–আমি এত কিছু জানি না।আলোচনাটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে বলল, হোমওয়ার্ক সব শেষ করেছিস?
তপু দাঁত বের করে হেসে বলল, করে ফেলেছি। আজকে অঙ্ক মিস আসে নাই, তাই কোনো হোমওয়ার্কও নাই!
শিরীন হেসে বলল, খুব মজা, না?