নিয়াজ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, টং করার জায়গা পাচ্ছিস না জয়ন্ত? এটা একটা ঢং করার ব্যাপার হল? ন্যাকামো হল।
হোক। জয়ন্ত পাথরের মতো মুখ করে বলল, তোরা যা।
শ্রাবণী, নিয়াজ এবং জব্বার মিয়া হতবুদ্ধি হয়ে দেখল, জয়ন্ত আবার গভীর অরণ্যের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটি অংশ বহন করছে যে প্রাণী সেই প্রাণীর তীব্র কৌতূহলকে সম্মান না দেখিয়ে সে ফিরে যেতে পারবে না।
জোছনার নরম আলোতে জয়ন্তের অপসৃয়মাণ দেহটিকে একটি অতিপ্রাকৃতিক প্রতিমূর্তির মতো মনে হতে থাকে।
.
চাঁদের আলোতে সমুদ্রের পানি কেমন জানি ঝিকমিক করছে। তার মাঝে চাপা শব্দ করে ট্রলারটি এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়াজ অনভ্যস্ত হাতে ট্রলারের হালটি ধরে রেখেছে সে। কল্পনাও করতে পারে না দুদিন আগে ট্রলারের উপর বসে থাকা নিয়ে তার ভেতরে একধরনের আতঙ্ক ছিল অথচ এখন সে এটি সমুদ্রের ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ট্রলারের ভেতরে জব্বার মিয়া লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার দুর্বল দেহে চেতনা আসছে এবং চলে যাচ্ছে। ট্রলারটি সোজা দক্ষিণে গেলে লোকালয় পাওয়া যাবে, সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। জব্বার মিয়া ভয় পায় না—সমুদ্রের বুকে সে এর থেকে অনেক বড় দুর্ঘটনাও পার হয়ে এসেছে। মৃত্যু বারবার আসে না একবারই আসে এবং সত্যি সত্যি যখন আসবে সে একটুও ভয় না পেয়ে তার মুখোমুখি হবে।
চাঁদটি এখন ঠিক মাথার ওপরে। পিছনে হকুনদিয়া দ্বীপ। জোছনার নরম আলোতে এত দূর থেকে হকুনদিয়া দ্বীপটি দেখা পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সেটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কারণ পুরো দ্বীপটি দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুনের কমলা রঙের শিখা জীবন্ত প্রাণীর মতো লকলক করে নাচছে। সমস্ত আকাশ সেই আগুনের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ট্রলারের ছাদে হাত রেখে শ্রাবণী দাঁড়িয়ে ছিল। সে জয়ন্তের হাত স্পর্শ করে বলল, মন খারাপ করিস না জয়ন্ত।
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, আমি দায়ী। আমি যদি ম্যাচটা না দিয়ে আসতাম!
শ্রাবণী নিচু গলায় জোর দিয়ে বলল, না, তুই দায়ী না। এই বেজিগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক সৃষ্টি না। এটা মানুষের তৈরি একটা কৃত্রিম সৃষ্টি। যেটা স্বাভাবিক না সেটা প্রকৃতিতে থাকে না, থাকতে পারে না।
কিন্তু আমি যদি ম্যাচটি না দিয়ে আসতাম তাহলে এতবড় আগুন লাগত না।
তোর ধারণা কাজটি ভূল হয়েছিল?
অবশ্যই ভুল হয়েছিল।
একটা ভুলের জন্যে যে প্রাণী সারা পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে যায় সেই প্রাণীর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কথা না।
কিন্তু।
না জয়ন্ত। এই বেজিগুলো ছিল একটা ভয়ঙ্কর ভুল। তোর আরেকটা ভুল দিয়ে সেই ভুলটিকে সংশোধন করা হল।
.
জয়ন্ত কোনো কথা না বলে দূরে হকুনদিয়া দ্বীপের দিকে তাকিয়ে রইল। আগুনের লাল আভায় পুরো আকাশটি আলোকিত হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর আগুনের মাঝে বেজিগুলো না জানি কী ভাষায় চিৎকার করে আর্তনাদ করছে।
স্ক্রিন সেভার
শিরীন ডাইনিং টেবিলে বসে কাজ করছিল। মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অসহিষ্ণু গলায় তপুকে উদ্দেশ করে গলা উচিয়ে বলল, তপু, কয়টা বেজেছে দেখেছিস?
তপু তার ঘর থেকে চিৎকার করে বলল, আর এক মিনিট আম্মু।
এক মিনিট এক মিনিট করে কয় মিনিট হয়েছে খেয়াল আছে?
এই তো আম্মু
প্রত্যেক দিনই একই ব্যাপার। ঘুমুতে দেরি করিস আর সকালে বিছানা থেকে টেনে তোলা যায় না।
এই তো আম্মু হয়ে গেছে।
শিরীন হাতের কাগজগুলো ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে তপুর ঘরে দেখতে গেল সে কী নিয়ে এত ব্যস্ত। যা অনুমান করেছিল ঠিক তাই। কম্পিউটারের কী–বোর্ডে দ্রুত কিছু একটা টাইপ করছে, মনিটরে উজ্জ্বল রঙের কিছু–একটা ছবি যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। শিরীন জোরে একটা ধমক লাগাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তপু উজ্জ্বল চোখে বলল, দেখেছ আম্মু? একটা নতুন স্ক্রিন সেভার। তুমি এটাকে গেম হিসেবে ব্যবহার করতে পার। যখন তুমি টাইপ করবে তখন লেভেল পাল্টাবে। যদি ঠিক ঠিক ম্যাচ করে তখন নতুন একটা রং বের হয়।
তপু ঠিক কী বলছে শিরীন ধরতে পারল না কিন্তু সে এত উৎসাহ নিয়ে বলল যে তাকে আর বকতে মন সরল না। বারো বছরের ছেলের নিজস্ব একটা জগৎ আছে সেটা সে দেখতে পায় কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। কাজেই সম্পূর্ণ অর্থহীন এই ব্যাপারটিতে খানিকটা উৎসাহ দেখানোর জন্যে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেয়েছিস এই স্ক্রিন সেভার?
আমার ই–মেইলে এসেছে।
কে পাঠিয়েছে?
আমি জানি না।
নাম নেই ঠিকানা নেই মানুষেরা কীভাবে অন্যদের সময় নষ্ট করার জন্যে এসব পাঠায় ব্যাপারটা শিরীন ভালো করে বুঝতে পারল না, কিন্তু সে বোঝার চেষ্টাও করল না। বলল, ঠিক আছে। অনেক হয়েছে, এখন শুতে যা।
তপু কম্পিউটারটা বন্ধ করতে করতে বলল, তুমি বিশ্বাস করবে না আম্মু, এই স্ক্রিন সেভারটা কী মজার। একই সাথে গেম আর স্ক্রিন সেভার। অন্য গেমের মতো না। এটা খেলতে মনোযোগ দিতে হয়। কত তাড়াতাড়ি তুমি উত্তর দাও তার ওপর সবকিছু নির্ভর করে। রংটা এমনভাবে পাল্টায় যে মনে হয় তোমার সাথে কথা বলছে। মনে হয়–
ব্যস, অনেক হয়েছে। শিরীন মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন দুধ খেয়ে দাঁত ব্রাশ করে ঘুমা।
দুধ খাবার কথা শুনে তপু আহারে জাতীয় একটা কাতর শব্দ করল কিন্তু তাতে শিরীনের হৃদয় দ্রবীভূত হল না।