শ্রাবণী বলল, বাইরে অন্ধকার, মোমবাতি জ্বালিয়ে নিই?
জব্বার মিয়া বলল, চাঁদনী রাত আছে। মোমবাতি জ্বালালে দূরে কিছু দেখবেন না। তাছাড়া বাতাসে নিভে যাবে।
জয়ন্ত বলল, হ্যাঁ, জব্বার মিয়া ঠিকই বলেছে। বাসা থেকে বের হবার সময় মোমবাতি নিভিয়ে নেব। ভালো জোছনা হলে পরিষ্কার দেখা যায়।
দলটি দরজা খুলে খুলে ধীরে ধীরে বের হল। করিডর ধরে হেঁটে সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল। ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নেমে এল। বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়ে আসে। জম্বার মিয়া ঠিকই বলেছে, আকাশে মস্তবড় চাঁদ। শহরে তারা কখনো অমাবস্যা পূর্ণিমার খবর রাখে না–আকাশে চাঁদটি ওঠে অপরাধীর মতো, ডুবে যায় অপরাধীর মতো। অথচ এখানে চাঁদটি কী ভয়ঙ্কর অহঙ্কারীর মতো পুরো আকাশটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে।
জয়ন্ত ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিতেই হঠাৎ করে জোছনার আলোতে চারদিক প্লবিত হয়ে গেল। মনে হচ্ছে পুরো এলাকাটি বুঝি জোছনার আলোতে উথালপাথাল করছে। শ্রাবণী নিশ্বাস ফেলে বলল, ইশ! কী সুন্দর!
জয়ন্ত বলল, আসলেই।
যদি একটু পরে মরে যাই তোরা কোন দাবি রাখিস না।
কেউ কোনো কথা বলল না। এই সুন্দর পরিবেশে ভয়ঙ্কর বীভৎস একটা মৃত্যুর কথা কেউ চিন্তা করতে পারছে না। শুধু জব্বার মিয়া নিচুগলায় বলল, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখেন। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে।
জয়ন্ত বলল, আয় রওনা দিই।
চার জনের ছোট দলটি নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে পথে নেমে এল। সুরকি বিছানো পথে তারা খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সামনে বড় বড় গাছ ঝোঁপঝাড় তার নিচে হাজার হাজার বেজি নিঃশব্দে বসে আছে, তারা জানে বেজিত্তলো তীক্ষ্ণচোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ড বুকের মাঝে ধকধক করে শব্দ করছে, প্রতিমুহূর্তে মনে হতে থাকে বেজিগুলো বুঝি তাদের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সবার আগে শ্রাবণী, তার পেছনে জব্বার মিয়া, জব্বার মিয়াকে দুইপাশ থেকে নিয়াজ আর জয়ন্ত ধরে রেখেছে।
কাঁপা–কাঁপা পা ফেলে শ্রাবণী আরো একটু এগিয়ে এল। এখন বেজিগুলোর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে এত কাছে যে প্রতিবার পা ফেলার আগে তাকে লক্ষ করতে হচ্ছে সে কোথায় পা ফেলছে, কোনো বেজির উপর পা ফেলে দিচ্ছে কি না। জোছনার আলোতে চারদিক থই থই করছে, তার মাঝে বড় বড় গাছের ছায়া। জোছনার নরম আলোতে সবকিছু দেখা যায় কিন্তু কিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না। গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে বেজিগুলো বসে আছে অনুভব করা যায়, কিন্তু ঠিক ভালো করে দেখা যায় না। নিশ্বাস বন্ধ করে শ্রাবণী আরো কয়েক পা এগিয়ে গেল। তার মনে হল হঠাৎ করে সামনে একটা বড় গাছের নিচে কিছু একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। হিংস্র শব্দ করে কিছু বেজি নড়তে শুরু করেছে। আতঙ্কে শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ড থেমে আসতে চায়–সে কাঁপা গলায় বলল, সুসু–সুসু…
সাথে সাথে সবকিছু যেন স্থির হয়ে যায়, নিঃশব্দ হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকায় হিংস্র চোখে বসে থাকা বেজিগুলো হঠাৎ যেন বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অনভ্যস্ত হাতে শক্ত করে ধরে রাখা বন্দুকটা নিয়ে শ্রাবণী আবার বলল, সুস সুস…।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার উচ্চকণ্ঠে বলল, সুসু সুসু…।
হঠাৎ করে প্রতিধ্বনির মতো কথাগুলো ফিরে আসতে শুরু করে। মনে হয় সমস্ত বনাঞ্চল যেন প্রতিধ্বনি করে ওঠে, সুসু সুসু…
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, কমিউনিকেট করা গেছে। মনে হয় বেঁচে গেলাম।
এখনো জানি না। শ্রাবণী বলল, হাঁটতে থাক।
চার জনের ছোট দলটা দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। হাতে ধরে রাখা সলভেন্টের ভারী বোতলগুলো ঠেলে নেওয়া কষ্টকর হতে থাকে। তারা তখন একটা একটা করে ফেলে দিয়ে আসতে থাকে। জোছনার নরম আলোতে লম্বা লম্বা পা ফেলে তিন জন এগুতে থাকে। তাদের ডানে বায়ে সামনে পিছনে বেজি। ধূসর বেজিগুলো সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিচ্ছে, তারা সে জায়গায় পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। একটু পরপর তারা দাঁড়িয়ে পড়ে চাপা গলায় বলছে, সুসু সুসু… যার অর্থ আমাদের মেরে ফেলো না প্লিজ! তার প্রত্যুত্তরে বেজিগুলোও বলছে, সুসু সুসুI পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতির কাছে সেটাও যেন অবোধ প্রাণীগুলোর এক ধরনের আকুতি।
জোছনার নরম আলোতে পা ফেলে ফেলে হাজার হাজার বেজিকে পিছনে ফেলে। তারা শেষ পর্যন্ত বালুবেলায় চলে এল। বালুবেদার নরম বালুতে পা ফেলে তারা এগিয়ে যায়। এই তো সামনে আর কিছুদূরে ট্রলারটি সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে দুলে উঠছে। আর কয়েক পা এগিয়ে গেলে তারা বেঁচে যাবে– ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন থেকে তারা রক্ষা পেয়ে যাবে।
ঠিক তখন জয়ন্ত দাঁড়িয়ে গেল। নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, কী হল?
তোরা যা আমি আসছি।
নিয়াজ অবাক হয়ে বলল, কোথা থেকে আসছিস?
বেজিগুলোর কাছ থেকে।
বিদায় নিয়ে আসবি? নিয়াজ খেপে গিয়ে বলল, গালে চুমু দিয়ে বিদায় নিয়ে আসবি?
না, একটা জিনিস দিয়ে আসব।
কী জিনিস?
ম্যাচটা। মনে নেই ম্যাচটার জন্যে কী করল?
নিয়াজ রেগে বলল, দ্যাখ জয়ন্ত পাগলামি করিস না। তোর একগুঁয়েমির জন্যে আমরা সবাই মরতে বসেছিলাম। এখন আবার একগুঁয়েমি করে ফেরত যাচ্ছিস? ফাজলেমির একটা সীমা থাকা দরকার।
জয়ন্ত বলল, তোদের যা ইচ্ছে বলতে পারিস। কিন্তু এই বেজিগুলো হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটা অংশ তাদের বুদ্ধিমত্তাকে সম্মান করতে হবে। তোরা যা, আমি ম্যাচ দিয়েই চলে আসব। বুদ্ধিমত্তার প্রথম স্টেপ হচ্ছে আগুন। ওদেরকে আগুন জ্বালানোর একটা সুযোগ করে দিই।