নিয়াজ বলল, ছেড়ে দেব?
শ্রাবণী বলল, আগেই ছাড়িস না। কথা বলার চেষ্টা করে দেখি। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বেজিটার দিকে তাকিয়ে বলল, সুসু।
হঠাৎ করে ম্যাজিকের মতো একটা ব্যাপার হল। বেজিটি এতক্ষণ ছটফট করে কাতর শব্দ করছিল, সবকিছু একমুহূর্তে থেমে গেল। বেজিটি প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে শ্রাবণীর দিকে তাকাল।
শ্রাবণী আবার বলল, সুসু।
নিম্নশ্রেণীর প্রাণীর চোখেমুখে আনন্দ বা দুঃখের ছাপ পড়ে না কিন্তু শ্রাবণীর স্পষ্ট মনে হল বেজিটির চোখমুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেছে। বেজিটি সামনের দুটি পা হাতের মতো নেড়ে নেড়ে বলল, সুসু সুসু…।
শ্রাবণী নিয়াজকে বলল, বেজিটাকে ছেড়ে দে।
ছেড়ে দেব?
হ্যাঁ। শ্রাবণী লাঠিটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিতেই বেজিটা মুক্ত হয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল, দৌড়ে পালিয়ে গেল না। শ্রাবণী চাপা গলায় বলল, দেখেছিস, এটা আমাকে বিশ্বাস করেছে!
হ্যাঁ। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, দ্যাখ বিশ্বাসটা আরো পাকা করা যায় কি না।
শ্রাবণী বলল, সুসু সুসু…
বেজিটাও বলল, সুসু সুসু…
শ্রাবণী চাপা গলায় বলল, একটা মোমবাতি আর ম্যাচটা দে।
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি একটা মোমবাতি আর ম্যাচ এগিয়ে দিল। শ্রাবণী ম্যাচের বাক্স থেকে একটা ম্যাচের কাঠি বের করে বাক্সের পাশে ঘসে আগুন জ্বালাতেই বেজিটি বিচিত্র একটি ভয়ের শব্দ করে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, ভয় পেয়েছে।
কিন্তু পালিয়ে যায় নি। দূর থেকে দেখছে।
শ্রাবণী নরম গলায় বলল, সুসু সুসু… তারপর ম্যাচটি দিয়ে মোমবাতিটি জ্বালিয়ে দিল। বেজিটি তীক্ষ্ণচোখে সেটি দেখে খুব ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসে মোমবাতিতে আগুনের শিখাটি দেখে। এর আগে এত কাছে থেকে কোনো বেজি আগুনের শিখা দেখে নি। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, বুদ্ধিমত্তার প্রথম ব্যাপারটাই হচ্ছে কৌতূহল। বেজিটার কী কৌতূহল দেখেছিস!
শ্রাবণী বলল, বেজি সাহেব, তোমাকে আমি আগুন জ্বালানো শিখিয়েছি। এখন আগুন নেভানো শিখিয়ে দেই। এই দ্যাখো এভাবে আগুন নেভায়– শ্রাবণী ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিতেই বেজিটি চমকে একটু পিছনে সরে গেল। কিন্তু পালিয়ে গেল না।
জয়ন্ত খুশি–খুশি গলায় বলল, কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় হয়েই গেছে–এবারে বেজিটাকে চলে যেতে দে।
শ্রাবণী বলল, যাওয়ার আগে কিছু-একটা উপহার দেওয়া যায় না?
কী উপহার দিবি?
ফুলের তোড়া আর মানপত্র।
ফাজলেমি করিস না। ম্যাচটা নেবার জন্যে পাগল কিন্তু সেটা এখন দেওয়া যাবে না।
ঠিক আছে– শ্রাবণী বলল, এই মোমবাতিটা দিই।
শ্রাবণী মোমবাতিটা বেজির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সুসু।
বেজিটা তার ছুঁচালো নাক দিয়ে মোমবাতিটা কয়েকবার শুঁকে সেটাকে কামড়ে ধরল। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যেতে শুরু করল। জয়ন্ত বলল, নিয়াজ দরজাটা খুলে দে। বেজিটাকে সসম্মানে যেতে দিই।
নিয়াজ দরজাটা খুলে দিতেই মোমবাতিটা কামড়ে ধরে রেখে বেজিটা লাফিয়ে বের হয়ে গেল।
.
জব্বার মিয়া একটা কাতর শব্দ করতেই জয়ন্ত মোমবাতিটা হাতে নিয়ে তার কাছে এগিয়ে যায়। শরীরের নিচে রক্তে ভিজে গেছে। জয়ন্ত চিন্তিত মুখে বলল, আবার ব্লিডিং শুরু হয়েছে।
শ্রাবণী এগিয়ে গিয়ে বলল, দেখি মোমবাতিটা ধর দেখি।
জয়ন্ত মোমবাতিটা ধরল, শ্রাবণী একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে জব্বার মিয়ার ক্ষতস্থানগুলো বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
নিয়াজ আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, কেউ যদি আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিত–আমি তাকে চোখ বুজে এক লাখ টাকা দিয়ে দিতাম।
মাত্র এক লাখ? শ্রাবণী বলল, আমি দশ লাখ দিতাম।
জয়ন্ত বলল, কল্পনাতেই যখন দিবি বেশি করে দে। টাকায় না দিয়ে ডলারে দে।
ঠিক আছে তাই সই। এক মিলিয়ন ডলার দিতাম।
তোরা এমনভাবে কথা বলছিস যেন সবাই এক একজন বিল গেটস।
ভৈরবের ফেরিতে ছোট ছোট বাচ্চারা পানি বিক্রি করে, এক গ্লাস পানি এক টাকা! এখন মনে হচ্ছে বিল গেটস না হয়ে ঐ পানিওয়ালা বাচ্চা হলেই ভালো হত–ঢক ঢক করে পুরো কলসি পানি খেয়ে ফেলতাম।
জয়ন্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, বলল, হ্যাঁ, এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। আয় বের হই।
বের হব? শ্রাবণী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জয়ন্তের দিকে তাকাল, তুই সিরিয়াস?
হ্যাঁ। যদি আক্রমণ করতে চায় বলব সুসু সুস…।
তারপরও যদি আক্রমণ করে?
তাহলে কিছু করার নেই। বন্দুক দিয়ে গুলি করে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে আগুন ধরিয়ে কোনোভাবে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করব।
শ্রাবণী দুর্বলভাবে হেসে বলল, একেকজনের কী দশা দেখেছিস?
যখন এনার্জি পাবি না তখনই চিন্তা করবি ট্রলার পর্যন্ত পৌঁছলেই বোতল ভরা ঠাণ্ডা পানি! সাথে সাথে শরীরে এড্রনালিনের ফ্লো শুরু হয়ে যাবে।
নিয়াজ বলল, সমস্যা শুধু জব্বার মিয়াকে নিয়ে।
জব্বার মিয়া সাথে সাথে চোখ খুলে বলল, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনারা যদি পারেন, আমিও পারব।
ঠিক আছে, তবে রওনা দিই। ওঠো বাই।
জব্বার মিয়া খুব ধীরে ধীরে বসল। তারপর জয়ন্তের হাত ধরে সাবধানে উঠে দাঁড়াল। জয়ন্ত উৎসাহ দিয়ে বলল, চমৎকার!
ছোট দলটি রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। শ্রাবণীর হাতে বন্দুক, নিয়াজের হাতে পাইপগান, জয়ন্তের হাতে কিরিচ। সবার হাতেই একটা করে লাঠি এবং মশাল। সলভেন্টের বড় বোতল সাথে আছে, প্রয়োজন হলে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যাবে।