জয়ন্ত কাধ স্পর্শ করে বলল, ঠিক আছে। এখন আর বেশি কথা বলবেন না। শক্তিটা বাঁচিয়ে রাখেন।
শ্রাবণী হামাগুড়ি দিয়ে নিয়াজের কাছে গিয়ে বলল, নিয়াজ তোর কী অবস্থা?
নিয়াজ চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, বেশি ভালো না।
ভালো না হলে হবে কেমন করে? উঠে বস।
নিয়াজ খুব কষ্ট করে উঠে বসল, একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যা পানির তৃষ্ণা পেয়েছে কী বলব!
শ্রাবণী হাসার চেষ্টা করে বলল, এই ট্রলারেই পানি আছে, চিন্তা করিস না।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আমি আর পারছি না। এখানে থেকে পানির তৃষ্ণায় মরার থেকে বাইরে বেজির কামড় খেয়ে মরা অনেক ভালো।
ঠিকই বলেছিস।
জয়ন্ত কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে আরো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বলল, এতক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। আমাদের ফেরত যাওয়ার কাজটা আরো কঠিন হয়ে গেল।
যত সময় যাচ্ছে তত দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বেজির দল আবার যদি এটাক করে, মনে হয় আর নিজেদের রক্ষা করতে পারব না।
কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, আমরা এতক্ষণ যখন পেরেছি, বাকিটাও পারতে হবে।
কীভাবে পারবি?
সেটাই চিন্তা করছি। জয়ন্ত দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের অস্ত্র হচ্ছে বন্দুক, পাইপগান, কিরিচ আর আগুন। কিন্তু সামরিকভাবে তার সমাধান করতে পারব মনে হয় না। সমাধানটা হতে হবে কূটনৈতিক!
শ্রাবণী শব্দ করে হেসে বলল, ভালোই বলেছিস।
না না, আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াসলি বলছি।
কিন্তু সেই কূটনৈতিক মিশনটা চালাবি কেমন করে?
সেটাই ভাবছি। বেজিগুলো ম্যাচটা নেওয়ার জন্যে খুব ব্যস্ত। সেটা দিয়ে একটা কম্প্রোমাইজ করা যেতে পারে। তুই বেজির ভাষা ব্যবহার করে দেখিয়েছিস যে তাদের সাথে ডায়ালগও করা যায়।
কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত মাত্র একটা শব্দ জানি, সেটা হচ্ছে ক্রিঁকি। এক শব্দ দিয়ে কূটনৈতিক আলাপ কেমন করে হয়?
সেটাই হয়েছে মুশকিল। জয়ন্ত চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, কথা দিয়ে যদি না পারি তাহলে কাজকর্ম দিয়ে করতে হবে। জেসচার দিয়ে করতে হবে।
কী হবে তোর সেই জেসচার?
জয়ন্ত কথা না বলে চুপ করে রইল এবং ঠিক তখন শ্রাবণী হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, ওটা কী?
শ্রাবণীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই টেবিলের নিচে তাকায়। মোমবাতির আলোয় দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। জয়ন্ত বন্দুকটা হাতে নিয়ে বলল, কী আবার হবে? একটা ধুমসো বেজি।
এটা এখানে এসেছে কেন?
এখনো জানিস না কেন আসে?
হ্যাঁ জানি। শ্রাবণী চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু যখন আসে তখন তো দল বেঁধে আসে। এখন একা এসেছে কেন? কোন দিক দিয়ে এসেছে?
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, তুই কি ভেবেছিস আমরা ল্যাবরেটরি–ঘরটা পুরোপুরি সীল করতে পেরেছি? পারি নাই। কত ফাঁকফোকর আছে। তার কোনো একটা দিয়ে ঢুকে গেছে।
শ্রাবণী চিন্তিত মুখে বলল, এমনভাবে বসে আছে যেন আমাদের সব কথা বুঝতে পারছে।
হ্যাঁ। জয়ন্ত বলল আমার ধারণা ব্যাটা স্পাইগিরি করতে এসেছে।
নিয়াজ একটা লাঠি নিয়ে বলল, দাঁড়া ব্যাটার স্পাইগিরি করা বের করছি।
কী করবি?
পিটিয়ে ঘিলু বের করে দেব।
আজ সারাদিনে তারা অসংখ্য বেজির ঘিলু বের করে দিয়েছে, শরীর থেতলে দিয়েছে, শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। কাজেই নিয়াজের কথাটা অর্থহীন আস্ফালন নয়। তবে প্রতিবারই এই বীভৎস কাজগুলো করেছে নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে। একসাথে যখন অসংখ্য বেজি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন হাতের লাঠিটা ঘোরালেই কিছু বেজি তার আঘাতে থেঁতলে গেছে। তবে এটা ভিন্ন ব্যাপার–নিয়াজ নির্দিষ্ট একটা বেজিকে একটা উচিত শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছে।
বেজি অত্যন্ত ধূর্ত প্রাণী। ল্যাবরেটরি ঘরে টেবিলের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা একটা বেজিকে নিয়াজ লাঠি দিয়ে কিছু একটা করে ফেলতে পারবে সেটা কেউই ভাবে নি। কিন্তু নিয়াজ হঠাৎ করে সেই অসাধ্য সাধন করে ফেলল। লাঠিটা দিয়ে আচমকা খোঁচা মেরে বেজিটাকে দেয়ালের সাথে আটকে ফেলে চিৎকার করে বলল, ধরেছি শালার ব্যাটাকে, যাবি কোথায় এখন? স্পাইগিরি করতে এসেছিস?
জয়ন্ত এবং শ্রাবণী এগিয়ে গেল। ধূসর রঙের বড়সড় বেজিটা লাঠির চাপে আটকা পড়ে কাতর শব্দ করছে। নিয়াজ হিংস্র গলায় বলল, আরেকটা লাঠি দিয়ে এই জানোয়ারের বাচ্চার মাথাটা থেঁতলে দে দেখি। বোঝাই শালার ব্যাটাকে মজাটা!
শ্রাবণী হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, পাগলামি করিস না।
কী হয়েছে?
শ্রাবণী মোমবাতিটা নিয়ে আরেকটু কাছে গিয়ে বেজিটাকে ভালো করে লক্ষ করে বলল, দেখছিস না এটা কোনো কথা বলার চেষ্টা করছে?
নিয়াজ এবং জয়ন্ত ভালো করে তাকাল, সত্যি সত্যি বেজিটা সামনের দুই পা-কে হাতের মতো নেড়ে কিছু–একটা বলার চেষ্টা করছে। তারা কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, দেখল বেজিটা মাথা নেড়ে অবিকল মানুষের গলায় বলল, সুসু সুসু।
শ্রাবণী উত্তেজিত হয়ে বলল, আরেকটা শব্দ শিখলাম। সুসু। সুসু মানে নিশ্চয়ই আমাকে মেরো না প্লিজ।
জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছিস। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল, দেখি এর সাথে কথাবার্তা চালানো যায় কিনা।
শ্রাবণী বলল, দাঁড়া, উল্টাপাল্টা কিছু বলে এটাকে কনফিউজ করিস না।
কী করব তাহলে?
যেহেতু এটা বলছে ছেড়ে দিতে, কাজেই এটাকে ছেড়ে দিতে হবে। এটা হচ্ছে ওদের কাছে নাইস জেসচার দেখানোর সুযোগ।