শ্রাবণী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অচেতন হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরেও কে জানি তাকে বলল, চেষ্টা কর–বেঁচে থাকার চেষ্টা কর। সে তাই শেষবার চেষ্টা করল, চিৎকার করে বলল, ক্রিঁকি ক্রিঁকি ক্রিঁকি।
হঠাৎ করে জাদুমন্ত্রের মতো বেজিগুলো থেমে গেল। একটি আরেকটির দিকে তাকাল। মনে হচ্ছে কিছু–একটা বুঝতে পারছে না। শ্রাবণী আবার বলল, ক্রিঁকি ক্রিঁকি ক্রিঁকি
সাথে সাথে বেজিগুলি লাফিয়ে তাদের শরীর থেকে নেমে গিয়ে অবিকল মানুষের গলায় ক্রিঁকি ক্রিঁকি ক্রিঁকি বলতে বলতে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
বেজিগুলো সরে যেতেই শ্রাবণী মাথা তুলে তাকাল। অন্য তিনজন সিঁড়ির ওপরে এবং নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদেরকে দেখে মানুষ বলে চেনা যায় না। দেখে মনে হয় রক্তাক্ত কিছু মাংসপিণ্ড। শ্রাবণী কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়–পাওয়া গলায় ডাকল, নিয়াজ, জয়ন্ত।
কোনোমতে নিয়াজ আর জয়ন্ত উঠে বসে। তারা বিস্ফারিত চোখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে থাকে–বেজিগুলো যে তাদের টুকরো—টুকরো না করেই চলে গেছে এখনো সেটা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না।
শ্রাবণী টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোরা উঠতে পারবি?
মনে হয় পারব। নিয়াজ বন্দুকটার ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শ্রাবণী গিয়ে জয়ন্তের হাত ধরে তুলল। জয়ন্ত আর নিয়াজ মিলে চেষ্টা করে জব্বার মিয়াকে টেনে তুলল। তারপর ছোট দলটা কোনোভাবে নিজেদেরকে টেনে হিঁচড়ে নিতে থাকে।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, শ্রাবণী, তুই কেমন করে জানলি যে ক্রিঁকি ক্রিঁকি বললে বেজিগুলো আমাদের ছেড়ে দেবে?
যদি জানতাম তাহলে আরো আগেই বলতাম। জানতাম না বলেই তো এই অবস্থা।
কী বলছিস তুই–আমরা জানে বেঁচে গিয়েছি জানিস?
আমি এত নিশ্চিত নই। একবার বেঁচে গিয়েছি মানে নয় যে সব বার বেঁচে যাব। তবে এইভাবে মরব কখনো ভাবি নি।
এখনো তো মরি নি–
শ্রাবণী কোনো কথা বলল না। জয়ন্ত আবার জিজ্ঞেস করল, তুই কেমন করে বুঝতে পারলি ক্রিঁকি ক্রিঁকি বললে ওগুলো চলে যাবে?
মনে নেই ল্যাবরেটরিতে প্রথম যখন এসেছিল পালিয়ে যাবার সময় একটা বেজি বলল ক্রিঁকি ক্রিঁকি। তখন সবগুলো মিলে পালিয়ে গেল।
হ্যাঁ। মনে আছে।
আমার তাই মনে হল হয়তো ক্রিঁকি ক্রিঁকি মানে, বিপদ বিপদ পালাও। সেটা শুনে হয়তো সবগুলো পালাবে।
নিয়াজ এই অবস্থায় হাসার চেষ্টা করে বলল, তুই বেজিদের একটা মাত্র শব্দ শিখেছিস–সেটা দিয়েই চারজন মানুষের জান বাঁচিয়ে দিয়েছিস। কী আশ্চর্য!
শ্রাবণী কোনো কথা বলল না। সে কোনোকিছু চিন্তা করতে পারছিল না, যদি পারত তাহলে বুঝতে পারত যে ব্যাপারটি সত্যিই খুব আশ্চর্য।
ল্যাবরেটরি–ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চারজন মেঝের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তাদের শরীর থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ে মেঝের বড় অংশ রক্তাক্ত হয়ে যেতে থাকে।
.
শ্রাবণী চোখ খুলে দেখল জয়ন্ত জব্বার মিয়ার হাত ধরে পালস পরীক্ষা করছে। শ্রবণী কোনোভাবে উঠে বসল। শরীরের নানা জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। একটু নড়লেই প্রচণ্ড ব্যথায় শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়, সেই অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে জয়ন্তের কাছে যেতে যেতে বলল, কী হয়েছে?
অবস্থা খুব ভালো না। তবে রক্তটা বন্ধ করা গেছে।
তবু ভালো।
হ্যাঁ। কিন্তু এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার।
শ্রাবণী বিচিত্র দৃষ্টিতে জয়ন্তের দিকে তাকাল। সে এখনো একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা ভাবছে ব্যাপারটি তার বিশ্বাস হতে চায় না। জয়ন্ত এলকোহলে ভরা একটা বিকার শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে, তোর শরীরের রক্ত মুছে নে। দেখতে খুব খারাপ লাগছে।
শ্রাবণী আবার জয়ন্তের দিকে তাকাল। দেখতে খারাপ লাগা–না লাগার ব্যাপারটি নিয়ে এখনো কেউ মাথা ঘামাতে পারে সেটিও তার বিশ্বাস হয় না।
জয়ন্ত নরম গলায় বলল, আয় কাছে আইয় তোর মুখটা মুছে দিই।
শ্রাবণী কিছু বলার আগেই জয়ন্ত একটা কাপড়ের টুকরো এলকোহলে ভিজিয়ে শ্রাবণীর কপাল এবং গালে শুকিয়ে থাকা রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল, তোকে সব সময় দেখেছি সেজেগুজে সুন্দর হয়ে থাকা একজন মানুষ। তাই তোকে এভাবে দেখলে আমরা ইনসিকিওর ফিল করি।
ক্ষতস্থানগুলোতে এলকোহলের স্পর্শ লাগামাত্র জায়গাগুলো তীব্রভাবে জ্বালা করে ওঠে। শ্রাবণী দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল। জয়ন্ত নিচুগলায় বলল, সবচেয়ে সমস্যাটা হয়েছে কী জানিস?
কী?
পানি।
হ্যাঁ তৃষ্ণায় বুকটা একেবারে ফেটে যাচ্ছে।
এত ব্লিডিং হয়েছে, যে আর পারছি না। এভাবে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
এরকম সময় জব্বার মিয়া চোখ খুলে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ট্রলারে আপনাদের জন্যে পানি নিয়ে এসেছি।
জয়ন্ত জব্বার মিয়ার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনার এখন কেমন লাগছে?
দুর্বল লাগছে। জব্বার মিয়া একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।
কেন চিন্তা করব না?
আমাদের জান হচ্ছে বিড়ালের জান। আমরা এত সহজে মরি না। আল্লাহ হায়াত দিলে বেজির বাচ্চা বেজি কিছু করতে পারবে না।
শ্রাবণী জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, এই হচ্ছে খাঁটি স্পিরিট।
জব্বার মিয়া আস্তে আস্তে বলল, তবে আপনারা যদি তখন না আসতেন তাহলে কেউ আমারে বাঁচাতে পারত না। আজরাইল জানটা কবচ করে নিয়েই ফেলেছিল।